Saturday, May 30, 2020

বৃষ্টিস্নাত জলপদ্ম

শীতের শেষদিকেই আজ নতুন রুমে এসে উঠেছে মাহিম। রুমটি মূলত চিলেকোঠা, অনেক পছন্দ হয়েছে মাহিমের। বাড়িটি দুই তলা, বাড়িটির নাম 'সোনেলা বৃষ্টি' দোতলার সিড়ি দিয়ে উঠে এসে ছাদ পেরিয়ে ছোট্ট ব্যলকনির মতো করে তার সাথেই চিলেকোঠার রুম। তার ব্যালকনি টি দক্ষিণ মুখি, নিচে সুন্দর ঘাট বাধা একটি পুকুর, পুকুর পাড়ে নানা বড় বড় গাছ গাছালির জন্য ছায়া। ব্যালকনির গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে একটি বড় কদম গাছ, আর ছাদের আরেক ধার ঘেষে আছে আরেকটি বকুল গাছ। ব্যালকনিতে দাড়ালেই মৃদু বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। তার উপরে আবার ছাদ একটা বোনাস বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে, ইচ্ছা হলে বিকেলে হাটা চলা করা যাবে, রাতে বসে আকাশ দেখা যাবে।  এখনকার যুগে জমিদারী স্টাইলে বাড়ি পাওয়া যায়না তার পরেও যশোর মিশনপাড়ার মাঝে এমন বাড়ি, যদিও বর্তমানের মতো কাঠখোট্টা স্টাইলের নয় কিন্তু অনন্য এক শিল্পিমনের পরিচয় পাওয়া যায় বাড়িটির আপাদমস্তকে।

যাই হোক বাড়িটির চিলেকোঠা মাহিম দেখেছিলো পাশের একটি ৫ তলা বিল্ডিং থেকে। তারপর থেকেই, এই চিলেকোঠা ভাড়া পাওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে তাকে, কারন বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে চান নাই কাউকেই। কিন্তু সে এমনই একটি চিলেকোঠা চায় সেটি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে বাড়ি মালিক মাসুম সাহেব কে। 
দু একদিনের মাঝেই সে কিছু ফুল গাছ কিনে আনে, হাস্নাহেনা,, কামিনী,, গন্ধরাজ,, বেলি আর দুটি লাল গোলাপের গাছ। ব্যালকনিতে টবে লাগায়। তার পর সেখানে ঝুলিয়ে দেয় তার অতি আদরের ককাটেল পাখিটি। রুমের ভেতরের দেয়ালের চারিদিকে সেটে দেয় কস্টেপ দিয়ে তার ফটোগ্রাফি গুলো। সব মিলিয়ে রুমটা গোছানো শেষ ব্যালকনি সাজানো শেষ করে ফেলে দু তিন দিনের ভেতরেই। বাড়িওয়ালা এসে তাজ্জব বনে যায়, তিনিও বেশ শিল্পের কদর করেন তাই মাহিমের এমন সৃষ্টিশীল মনের পরিচয় পেয়ে বেশ মুগ্ধ হয়ে যান। 
---------------------------------------------------------

বসন্ত কাল পেরিয়ে চলে আসে বৃষ্টির সিজন। এখন প্রায় প্রতি বিকালেই আকাশ কালো করে আসে বৃষ্টি। কদম গাছটিতে ফুল এসেছে। বসন্তের সময় বকুল গাছটিতে অনেক ফুল ফুটেছিলো, ছাদে ঝরে পড়তো রাতে, প্রতিদিন সকালে মাহিম সেগুলো গুছিয়ে মালা বানিয়ে তার রুমে, ব্যালকনিতে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। বকুল ফুল এখন আর গাছে নেই কিন্তু ছাদে উঠলেই ফুলের সুবাস পাওয়া যায়। 

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি তাই মাহিম ক্লাসে যায়নি। ও যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছে অনু-জীববিদ্যা নিয়ে। রুমের সামনে ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি দেখেছে সারা বেলা তার পরে বৃষ্টি কমে এসেছে দুপুরে কিন্তু আকাশ মেঘলা আর ঠান্ডা শিতল বাতাসে ওর দু-চোখ জড়িয়ে এলো ঘুম। গভীর ঘুম হলো তার, সন্ধার আগে ঘুম থেকে উঠে গেঞ্জি আর একটি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে বের হয়ে ব্যালকনিতে এসে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো, বকুল ফুলের মালা যেগুলো ব্যালকনিতে ছিলো একটিও নেই, পাখির খাচাটায় পাখি নেই। এমন চুরি কে করলো। সার্বক্ষণিক গেট অফ থাকে তার উপরে গেটম্যান থাকে আর এই বাড়ি দু-তিনমাসের মাঝে কেয়ারটেকার তফিজ আলি আর মালিক মাসুম সাহেব ছাড়া কাউকেই সে দেখেনি। কারন মাসুম সাহেবের স্ত্রী মারা গিয়েছেন যখন মাসুম সাহেবের ছোটো মেয়ে বৃষ্টি'র বয়স ৩ বছর, তার পর থেকে তিনি আর বিয়ে করেন নাই। তার দুই কন্যা, তারাও ঢাকা থাকে তাই কেই বা থাকে বাসায়। মাহিম এদিক ওদিক তাকিয়ে একটি উপন্যাস পায় হুমায়ুন আহমেদের নাম 'মন্দ্রসপ্তক' বইটির প্রথম পেজ উল্টাতেই বইটিতে সুন্দর করে স্টাইল করে লিখা 'S', মাহিম বুঝতে পারে যার এই বই তার নাম শুরু হয়েছে S দিয়ে আর সেই হয়তো চোর।

সেই রাতে ১০ টার পরে বাড়িমালিক বাসায় আসলে মাহিম অভিযোগ করে এই চুরির, আর বইটিও দেখায়। মাসুম সাহেব বইটি হাতে নিয়ে এদিক ওদিক দেখে বললেন আচ্ছা আমি দেখি কি করা যায়। পরদিন সকালে খুব মন খারাপ নিয়ে ঘুম থেকে উঠেই মাহিম দেখতে পায় ব্যালকনিতে একটি ছোট্ট টুলের উপরে বকুল ফুলের মালা গুলো আর পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া ছোট্ট একটি চিরকুট যাতে লিখা "স্যরি, পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছি, খুব ভালো পাখিটি। আর আপনার মালা গুলো ফেরত দিয়ে গেলাম_ S"
মাহিমের বুঝে আসলোনা কে এই S, তবে এটা বুঝতে পারলো যেই হোক সে আগে এখানে ছিলোনা। সে আরেকটি চিরকুট লিখলো "পাখিটি ছেড়ে দিয়ে ভালো করেন নি, আর মালা গুলি ফেরত দিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ, তাই আপনার জন্য দুটি মালা রাখলাম, আর 'S' এর মানেটা যানতে চাই_মাহিম" চিরকুট টা রেখে সে বিকালে বাড়ির সামনে নিচে বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে ভাবলো আজ রাতে চিরকুটটা মনে হয় নিয়ে যাবে, কিন্তু এসেই দেখলো চিরকুট টা নেই। সে খুব অবাক হলো, কারন বাইরে গিয়েছে ১০ মিনিট দাড়িয়ে ছিলো রাস্তায় গেটের সামনে কিন্তু কেউ তো ঢুকেনাই বাড়ি তাইলে কি মালা চোর এই বাড়িতেই থাকে। 
যাই হোক পরের দিন সকালে উঠে আবার একটা চিরকুট, তাতে লিখা, "পাখি আকাশে উড়লেই ভালো লাগে তাই ছেড়ে দিয়েছি, আর বকুল মালা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনি কি করেন জানতে পারি কি? _ S
N.B: এই চিঠির জবাব টি ঠিক সন্ধা ৬ টা থেকে ৭ টার ভেতরে লিখে আপনার ব্যালকনির সামনে দিয়ে নিচের জানালা পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেবেন।"
মাহিম খুব অবাক হয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে চিঠিটা পড়ছে আর ভাবছে কে এই চোর যে এমন চিঠি লিখছে এই যুগে, হস্তাক্ষর স্পষ্ট মেয়েদের। মাহিম সারাদিন ভেবে ভেবে ৬ টা বাজার দশ মিনিট আগে লিখলো, "শুভেচ্ছা নিবেন,, আমি আপাতত PHD করছি JUST থেকে অনু-জীববিদ্যা নিয়ে। আর বলতে পারেন অকম্মা, প্রকৃতি দেখি, ছবি তুলি আর কবিতা লিখি খেয়াল খুশি মতো। কিন্তু আপনার নাম টা অন্তত বলতে পারতেন, আশা করি জানাবেন।" লিখে ঝুলিয়ে দিলো। 

চিঠি দেওয়া হয়ে গেছে দু তিন দিন হয়ে গেলেও আর জবাব মিললোনা চিঠির। সেদিন বিকালে আকাশ ঘিরে এলো মেঘ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো, মাহিম ব্যালকনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলো আর আনমনে ভাবছিলো কোনো খেয়াল সে রাখেনি কিছুর। হঠাৎ মুখে পানির ঝাপটা পাশ থেকে লাগায় সম্বিত ফিরে পায়। সে তাকিয়ে দেখে একটা ভেজা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ, থ্রিপিস পরা, ভিজে শরীরে লেগে গিয়েছে। তার পাশে এসে দাড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় এতক্ষণ ছাদে ভিজছিলো। মাহিম লজ্জা পেয়ে গেলো, বললো, "কে আপনি? আগে তো দেখিনি।"
মেয়েটি বললো, "আমি এতক্ষণ ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, ঘুরে বেড়ালাম, আপনাকে ডাকলাম কিন্তু কি এমন ভাবছিলেন যে কিছুই খেয়াল নেই।"
মাহিম বললো, "সেটা আপনাকে বলবো কেনো, আপনি কে আগে সেটা বলেন, আর এখানে কিভাবে এলেন।"
মেয়েটি বললো, "আপনি এখানে আমার রুম দখল করে নিয়েছেন আমার ছোটোবেলার অর্ধেক সময়ই এই রুমে কেটেছে, এবারই দেখলাম আপনি দখল দিয়েছেন, আবার আমাকেই উল্টা প্রশ্ন করছেন। কিন্তু আপনি রুমটা অনেক সাজিয়ে রেখেছেন তাই কিছু বলিনাই, নইলে আপনি যখনই আমার বাবার কাছে নালিশ করেছিলেন সেদিনই এই বাসা ছেড়ে দিতে হতো। আর আমি যশোর এখন থাকিনা তাই, থাকলে আপনাকে এই রুম দিতাম ই না।"
মাহিম আমতা আমতা করে বললো, "ও আপনিই তাইলে আমার মালা চুরি করেছিলেন......"
মেয়েটি মাহিমকে থামিয়ে দিয়ে বললো, "চুরি ক্যমনে হয়, আমার গাছ আমার ফুল, আপনি চুরি করে মালা বানিয়েছিলেন, তাও তো ভাগ্য ভালো আপনার আমি ফেরত দিয়েছিলাম।" 
মাহিম বললো, "স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি, আপনি সব গুলোই নিয়ে যান সমস্যা নেই, কিন্তু আপনার নামটা কি।"
মেয়েটি বললো, "বাড়ির নামটা কি কখনো দেখেছেন, আর বৃষ্টি আমার ছোটোবোনের নাম"
মাহিম বললো, "ও তাইলে আপনার নাম সোনেলা নিশ্চই।"
মেয়েটি বললো, "হ্যা ঠিক তাই, ভিজবেন বৃষ্টিতে, আসুন ভিজি"
মাহিম বললো, "এখন..... আমি তো বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করি, কিন্তু ভিজে তো দেখিনি কখনো।"
সোনেলা বললো, "আসুন ভিজেই দেখুন আজ কেমন লাগে।" 
মাহিম ছাদে এসে এক পাশের হাফ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়ালো, আর দেখতে লাগলো, সোনেলা ছাদের মাঝে এসে ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি সিক্ত হচ্ছে, ভেজা চুল কপাল পিঠ আর ঘাড়ে লেপ্টে আছে। সোনেলা মাঝ ছাদে বসে পড়লো দুই হাতে ছাদে জমা পানি নিয়ে খেলছে মেয়েটা, আর মাহিম অবাক চোখে দেখছে। সে সারাজীবন প্রকৃতি দেখেছে আর ভেবেছে কিন্তু প্রকৃতি যেই নারীকে সাজিয়ে সুন্দর হয় সেই নারীর এমন রুপ সে কখনোই দেখিনি। 
সোনেলা ডাকলো "কি হলো আপনার কি ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, সাতার পারেন আপনি, চলুন না নিচে নেমে পুকুরে সাতার কাটি, বৃষ্টির সাথে সাতার কাটতে খুব ভালো লাগে কিন্তু, একা নামতে ভয় করে।"
মাহিম বললো, "চলুন", সে কিছুতেই আর নিয়ন্ত্রন পাচ্ছেনা, আজ যেনো তার সকল ইচ্ছা শক্তিই রহিত হয়ে গেছে এক অচেনা কোনো আকর্ষণে।
পুকুরে মেয়েটি সাতারের কথা বললেও সাতার সে পারেনা, পুকুরের ঘাট ধরে দুই পা দাপিয়ে সাতার কাটছে। মাহিম দুই পা পানিতে ডুবিয়ে বসে আছে, মেয়েটি বললো আপনি সাতার জানেন  , আসুন আমি আপনাকে দেখাই।
মাহিম বললো, " দেখান",
সোনেলা বললো, "আমার মতো এভাবে ঘাট ধরুন তার পরে আমার মতো পা নাড়ান জলে। "
মাহিম মেয়েটির পাশে এভাবেই ভাসতে লাগলো, মাহিম সাতার জানে ভালোভাবেই কিন্তু ওর পাশে ভাসতে ভালোই লাগছে, সোনেলা মাহিমের ডানে ভাসছে, মাহিম ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সোনেলা হঠাৎ এদিকে তাকালো, মাহিমের সাথে চোখে চোখ হলো মাহিম লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। সোনেলা হেসে বললো, "চলুন বসি বিশ্রাম নেই, উঠতে হবে।" বলে ঘাটে উঠে বসলো, আর দুই পা পানিতে দিয়ে মাঝ পুকুরে তাকিয়ে থাকলো।
মাহিম বললো, "কি দেখেন, উঠবেন না, ঠান্ডা লেগে যাবে।"
সোনেলা বললো, "ঐ দেখুন পুকুরের মাঝে ফুটেছে লাল পদ্ম, আমি ছোটকাল থেকে দেখে আসি ঐ পদ্ম পরিবারটিকে, আগে একটা নৌকা ছিলো এখানে বৈঠার নৌকা। সেটি নিয়ে আমি ফুল ছিড়তাম, এখন নৌকাও নেই তাই কেউ ফুল আনতেও পারেনা। বাবাকে বলবো, একটা নৌকা কিনে আনতে আবার।"
মাহিম ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো, আর বললো, "পদ্মফুল নিবেন আপনি" বলেই পানিতে দুই হাত দিয়ে দ্রুত জল কেটে চলে গেলো মাঝ পুকুরে, সবচেয়ে বড় পদ্মফুলটি তুলে নিয়ে আসলো সোনেলার অবাক চোখের সামনে। এনে ঘাটে সোনেলার পাশের ঘাট ধরে সোনেলার হাতে দিয়ে বললো নিন।
সোনেলা, "ফুল নিলো তার পরে কোলের উপর রেখে দুই হাতে মাহিমের চুল ধরে বললো আপনি সাতার জানেন অথচ বললেন না যে, তবে ধন্যবাদ ফুল এনে দেয়ার জন্য। এখন থেকে যখনই চাইবো তখনই পানিতে নেমে আমার জন্য ফুল এনে দেবেন।"
মাহিম হেসে বললো, "আপনি বললেন যে এভাবে ধরে সাতার কাটতে হয় তাই আপনি যেভাবে আগ্রহ নিয়ে আমাকে শিখালেন, তাই আপনার পাশে তখন আপনার মতোই ভাসলাম। আর এটা আমার ছোটোবেলার শেখা সাতার তাই আপনাকে দেখালাম।"

দুজনেই এর পরে উঠে গেলো উপরে, ততক্ষণে বৃষ্টি নেই তবে আকাশ জুড়ে আছে মেঘ। এমন মেঘেঢাকা কিন্তু বৃষ্টির পরের পরিবেশ ও মাহিমের ভালো লাগে, সোনেলা ঘরে চলে গেলো, মাহিম ও উপরে তার ঘরে এসে শরীর মুছে কাপড় নেড়ে দিয়ে ছাদে এসে দাড়ালো। তার চোখে ভাসতে লাগলো ঘন্টা খানেক আগের ঘটনা, তাকালো ছাদের মাঝে এ যায়গায় সোনেলা মেয়েটা হাত পা ছুড়ে বৃষ্টির পানির সাথে খেলছিলো মেয়েটি। তার সমগ্র অনুভূতি জুড়ে নিয়েছে মেয়েটি, সে কেনো এমন ভাবছে নিজেও জানেনা মাহিম। আজকের পুরো দিনটাই যেনো হয়ে গেছে সোনেলা ময় আর সে যেনো মাঝে মাঝেই দু কানে শুনতে পাচ্ছে সোনেলার উচ্ছল আর তার হাসির শব্দ। কি আশ্চর্য সৌন্দর্য নারীর ভাবছে মাহিম অবাক হয়ে, আগে মাহিম প্রকৃতির রুপ দেখছিলো কিন্তু যেই সোনেলা বাইরে এলো সেই প্রকৃতিই যেনো সোনেলাকে সাজিয়ে দিলো নৈসর্গিক ভাবে যেনো প্রকৃতিই মুগ্ধ চোখে সাজাচ্ছিলো নারীকে। মাহিম হারিয়ে গেলো বৃষ্টি ভেজা অচেনা কারো মাঝে।
--------------------------------------------
দুদিন পর, ভার্সিটিতে অনেক কাজ ছিলো, মাহিমের ফিরতে ফিরতে সন্ধা হয়ে গেলো। এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ছাদে দাড়িয়ে ছিলো, পশ্চিমাকাশ তখনও লাল হয়ে আছে। মাহিমের মনে তখনও দুদিন আগের ঘটনা জটলা পাকিয়ে আছে। ঠোটের কোনে মৃদু হাসি চলে এলো তার, আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে গুন গুন করতে ভালোই লাগছিলো মাহিমের। 
সোনেলা ছাদে এসে মাহিমকে এ অবস্থায় দেখে তার পাশে এসে বলে হেল্লো শুভ সন্ধা, কেমন আছেন। কি গাচ্ছিলেন গুনগুন করে। 
মাহিম বলে, "তেমন কিছুই না, কিছুই গাচ্ছিলাম না, আকাশটা দেখছিলাম, সন্ধাটাকে উপভোগ করছিলাম মাত্র। আপনি কেমন আছেন"
সোনেলা বলে, "আমি ভালো আছি, সেদিন ফুল তুলে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। চা খাবেন আপনি?"
মাহিম বলে, "আচ্ছা খাওয়া যায়, আপনি বসুন আমার রুমে ইলেক্ট্রিক হিটার আছে চা বানিয়ে আনি।"
চা বানিয়ে নিয়ে এলো মাহিম, সোনেলা চায়ের কাপ নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ালো, চায়ের কাপে ঠোট দিয়ে একটু খেয়ে বললো ভালোই তো বানান দেখছি, তো রান্নাও তো নিজ হাতেই করেন মনে হয় তাইনা। আপনার বৌ কোথায় থাকেন?"
মাহিম হাসতে হাসতে বললো, তাই বুঝি, আমার বৌ আসবে কই থেকে এখনো বিয়েই তো করতে পারিনি, আর মা বাবা সেই মাধ্যমিক পড়ার সময়ই মারা গিয়েছেন। তারা বেচে থাকলে বিয়ে হয়ে যেতো। কিন্তু এখন একা ছেলের ঘটকালি আর করবে কে।
সোনেলা বললো, স্যরি, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আপনার আর কে আছেন। 
মাহিম বললো, "ছোটো বোন আছে, অনার্স শেষ হলে, গত বছর তাকে বিয়ে দিয়েছি। আর যারা আছে তারা নামে মাত্র আত্নীয়, মুল শিকড় না থাকলে কি আর মামা খালু চাচা পরিচয় পাওয়া যায়।"
সোনেলা বললো, "ঠিক ই বলেছেন, থাক অসব আলোচনা, আপনার চা বানানোর হাত কিন্তু প্রশংসনীয়, আমাকে একদিন রান্না করে খাওয়াবেন কিন্তু।
মাহিম বললো, " ওতটা ভালোনা আমার রান্না, ব্যাচেলর মানুষ কোনোরকমে খাই, আপনার পছন্দ হবেনা। আপনি কি করেন সেটা তো কখনো শুনা হলোনা"
সোনেলা বললো, "সে যেমনই হোক আমি খাবো একদিন, আর শুনুন, আমি আপনার মতো এতো পড়ালিখা করিনা, কোনো রকমে প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে অনার্স করছি।"
মাহিম বললো, "খুব ভালো, প্রাইভেট ভার্সিটি মোটেই খারাপ নয়।"
সোনেলা বললো, "আপনার রুম টা একটু দেখতে ইচ্ছে করছে, ব্যালকনি টা এমন সুন্দর করে সাজিয়েছেন তো রুমটাও নিশ্চই সাজানো।"
মাহিম বললো, "কিছুটা আছে, চলুন।"
সোনেলা রুমে ঢুকে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে নিলো, তার পর বললো এই সব লাইন লিখে লিখে রেখেছেন অনেক সুন্দর, কিন্তু কার রচনা এগুলো।
মাহিম বললো, "আর বলবেন না, ওগুলো আমার এলোমেলো চিন্তার রচনা।" 
সোনেলা বললো, অনেক সুন্দর হইছে তো, আপনি তো সুন্দর ছবিও তুলেন, আমাকে কিছু ছবি তুলে দিবেন একসময়।
মাহিম বললো, "হ্যা দিবো, কবে তুলবেন আপনি?"
সোনেলা বললো, "কাল বিকালে তুলে দিবেন তাহলে"
মাহিম বললো, "ওকে তাই হবে"
সোনেলা চলে গেলো, পরদিন বিকালে সোনেলা ছাদে এলো একটি শ্যাওলা কালারের শাড়ি সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পরে, কপালে সবুজে ঘেরা কালো রঙের টিপ। নাকে ছোট্ট একটা নাকফুল, পায়ে নুপুর, কানে একটি বড় সাইজের টপ, আর গলায় পাথরের একটি ডায়মন্ডের লকেট বসানো মালা। 
বিভিন্ন এক্সপ্রেশনে ছবি তুলা শেষ করে মাহিম। সোনেলা ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। রাতের বেলা মাহিম ঘরে বসে বসে ছবি গুলো দেখছিলো, দেখতে দেখতে তার মনের ভেতর অনুভূতি গুলো কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে, সব হারিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির গালে হালকা টোল আছে, হাসলে মনে হয় মুক্তো ঝরে, সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে এই মোহিনী রুপ দান করেছেন।

কয়েকদিন পর এক সকালে মাসুম সাহেব এসে, মাহিমকে বলেন বাবা কেমন চলছে দিনকাল। তোমার তো খবর নেয়া আমার হয়ে উঠেনা। কাল আমার বড় মেয়ের জন্মদিন, তাই তোমাকে দাওয়াত দিতে এলাম। আমার ছোটো মেয়েটাও আসছে। আর হাতে গোনা কয়েকজন আসবেন তুমিও এসো৷ আজ রাত সাড়ে এগারোটার ভেতরেই পৌঁছে যেয়ো নিচে। মাহিম বললো ঠিক আছে চাচা। মাহিম অনেক ভেবেও ঠিক করতে পারছেনা কি দেওয়া যায় উপহার সোনেলা কে। 

মাহিম ভাবে যে সোনেলা যেদিন এখানে মালা নিতে এসেছিলো উচ্ছল চোর বালিকা (ভাবতেই হাসি ফুটে উঠে মাহিমের ঠোটে) সে অনেক কিছুই চুরি করে ফেলেছে এর মাঝেই, এর মাঝে সবচেয়ে বেশি চুরি করেছে মাহিমের ভাবনা গুলোকে। মাহিম বিকালে লাইব্রেরী থেকে হুমায়ুন আহমেদের একটা বই কিনে আনে বইটির নাম "জলপদ্ম" এনে, বইয়ের কভার পেজের উল্টিয়ে লিখে 
"উপহার, সোনেলার জন্মদিনে _ মাহিম।" তার নিচে কয়েকটি 
লাইন,"যখন বৃষ্টির জল ধারার মতো তোমাকে সিক্ত করে তুলছিলো ঠিক যেনো ভেজা কদম ফুল, বকুলের ফুল থেকেও বেশি মোহিনী। ভাবনার করিডোরে তুমি সেই জলপদ্ম যার জন্য পার হওয়া যায় সাগর সম জল। সিক্ত দেহে তোমায় দেখে হারায় অনুভুতি, তোমার হাসিতে উচ্ছলে হারায় চেতনা। অফুরন্ত তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যায় বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে।"
সেদিন রাতে বার্থডে পালনের সময়, মাহিমের দুচোখ বড়ই নির্লজ্জের মতো সোনেলার উপর থেকে সরছিলোনা। মাহিম গিফট টা সোনেলাকে দিয়ে একটু দুরে সরে দাড়িয়ে ছিলো, কিন্তু চোখ তার সোনেলার উপরেই ছিলো। অনেক সুন্দর লাগছিলো তাকে। আজ একটি লাল জরজেটের শাড়ি পরেছিলো, খোলাচুলে তার অর্ধেক মুখ ঢেকে গিয়েছিলো দেখে মাহিমের কাছে যেনো অপ্সরি বলে মনে হচ্ছিলো, সোনেলার বোন বৃষ্টিও অনেক সুন্দর কিন্তু সোনেলার সাথে দাড়ানোয় তাকে ম্রিয়মান বলেই মনে হচ্ছিলো। সোনেলার চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয় মাহিম। তার এই ২৯ বছরের বয়সে এই প্রথম সে কোনো নারীকে এত মোহিনী রুপে দেখেছে চোখের আর দোষ কোথায়।

পরদিন বিকালে আবার সোনেলা ছাদে আসে, এসে মাহিমকে ডেকে নেয়, বলে অনেক সুন্দর লিখেছেন তো, আপনার উপহারটি আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে, আপনি অনেক সুন্দর লিখেন তো। এক কাপ চা খাওয়াবেন, আপনি। 
মাহিম বলে, "হ্যা খাওয়াবো।" চা বানিয়ে নিয়ে আসে মাহিম, সোনেলা ছোট্ট শব্দ করে চা খায়, মাহিমের কাছে খুব ভালো লাগে সোনেলার চা খাওয়া দেখতে। সোনেলা বলে ওকি কি দেখছেন, চা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো, চা খান। 
মাহিম থতমত খেয়ে বলে, জি আচ্ছা" সোনেলা আবারো হেসে ফেলে, মাহিমের চা গলায় যাচ্ছে কিন্তু চোখ উচ্ছল সোনেলার গালের টোলের উপর। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেনো। 

তার পর কয়েকদিন আবার সোনেলার দেখা নেই। এর মধ্যে বৃষ্টি এসে একবার পরিচিত হয়ে গেছে মাহিমের সাথে। সে খুবই বিরক্ত ব্যালকনিতে গাছ পালা দেখে, তার মনে হয়েছে এসব অগোছালো।লোকেদের কাজ।
এক রাতে মাহিমের ফোনে sms আসে অচেনা নাম্বার থেকে, "ei apni ki ghumiye giyechen?" 
মাহিম লিখে, "ke apni?"
উত্তর আসে, "Ghum aschena, chad e asen dekhen ki sundor rupali josona"
মাহিম বাইরে এসে দেখে ছাদে সোনেলা দাড়িয়ে আছে, খোলা চুলে, লিলুয়া বাতাসে উড়ছে চুল, রুপালী জোসনায় ভরে গেছে ছাদ। তার ব্যালকনিতে ফোটা কামিনি ফুলের ঘ্রানে মউ মউ করছে চারিদিকে। মাহিম অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আকাশের চাঁদের দিকে নয় রুপালি জোসনায় ছাদে নেমে আসা চাঁদের দিকে।
সোনেলা বলে, "এই যে হেল্লো, এদিকে আসুন, ছাদে শুয়ে চাঁদ দেখার মজাই অন্যরকম, তবে একা আমার ভয় করছিলো খুব,,  তাই আপনাকে ডাকলাম।"
মাহিম বলে, "আপনার বোনকে ডাকতে পারতেন।"
সোনেলা বলে, "আপনার ঘুম নষ্ট হলে, চলে যেতে পারেন।"
মাহিম বলে, "না নষ্ট হচ্ছেনা, বরং ভালো লাগছে অনেক বলে ছাদে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে"
সোনেলাও মাথার নিচে হাত দিয়ে মাহিমের পাশে শুয়ে পড়ে। তার পর বলে আচ্ছা একটা গান শুনাবেন আপনি, একদম কোমল সুরে বললো সোনেলা।
মাহিম বললো, আমার গলা বড়ই বেসুরো, আপনার ভালো লাগবেনা।
সোনেলা বললো, "সেটা আমার ব্যাপার আপনি শুনান প্লিজ। আমি শুনবো আপনার গান।" 
মাহিম উঠে বসলো বললো, "আচ্ছা শুনেন"
""এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।।
মনে রেখো তুমি
কত রাত কত দিন
শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন
অধরে তোমার ফোঁটাতে হাসি
চলে গেছি শুধু
সুর থেকে কত সুরে.............।।
 গানটি শেষ হলে সোনেলা বললো, "অসাধারণ গান তো আপনি, আমি মুগ্ধ, সত্যি আমি প্রতিদিন আপনার গান শুনতে আসবো, আপনি না করবেন না।"
মাহিম বললো, "আপনি একটা গান গেয়ে শুনান প্লিজ"
সোনেলা বলে, "গান আমি গাইতে পারিনা ভালো, কিন্তু এই জোসনা দেখে গাইতে ইচ্ছা হচ্ছে।"
সোনেলা গায়, 
"মায়াবী জোসনায় যদি পারতাম হেটে হেটে
ঐ বালুকাবেলায় হারাতে,
নীল মলাটের এই ডায়রিটাতে
যদি থাকতো লিখা,,,,,,,,,"
মাহিম বলে এটা কার লিখা গান আগেতো শুনিনি।
সোনেলা হেসে বলে, "এটা এই সোনেলার লিখা"
মাহিম কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় বৃষ্টি ছাদে এসে বললো, "আপু ঘুমাবানা, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে ১২ টা বেজে গেছে।"
মাহিম বললো, "শুভ রাত্রি, ভালো থাকবেন।"
মাহিম ঘরে যেয়ে সোনেলার নাম্বারে মেসেজ করলো, "Apni onek sundor gaite paren."
প্রতুত্তর আসলো, "Thanks, ami kal rate abar asbo apni asben to."
মাহিম লিখলো, "apni asle ami asbo nishcoi. Ar apnar sathe katano somoy gulo khub valo lage amar. Apnar opekkhay thakbo."
সোনেলা উত্তর দিলো, "amaro valo lage, ghumiye jan, shuvo rattri."

পরদিন সকালে দরজায় খট খট শব্দ, মাহিম চোখ মেলে দেখলো কেবল ৮ টা বাজে এতো সকালে কে এলো। আজ ছুটির দিন তাই ওর ভার্সিটি অফ, তাই মাহিম ঘুমাচ্ছিলো, মাহিমই সবার আগে ঘুম থেকে উঠে। মাহিম দরজা খুলেই দেখে বৃষ্টি দাড়িয়ে আছে।
 মাহিম বললো, "কি হইছে আপু, এতো সকালে আপনি।"
বৃষ্টি বলে, "আপনি যা সব করছেন এগুলো ঠিক হচ্ছেনা, আপনি কি করছেন একবার ভেবেছেন। ছোটোলোক ছোটোলোকের মত থাকবেন, বড় বাড়ি দেখে আর লোভ সারেনা তাইনা"
মাহিম বলে, "আপু আমি বুঝছিনা কি হইছে একটু খুলে বলেন আর আমাকে এতো গালি দিচ্ছেন কেনো?"
বৃষ্টি বলে, "গাল দিবোনা, আমার আপু বোকা বলে তাকে পটানোর চেষ্টা করছেন, আর ভাবছেন ওকে পটিয়ে বিয়ে করলেই এই বড় বাড়িতে উঠতে পারবেন, ওসব হবেনা আমি সব বুঝি। ছোটোলোক দের আচরন এমনই হয়। আর যদি কখনো দেখি আমার আপুর সাথে কথা বলছেন তাহলে আপনার খবর আছে। বাবাকে বলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।"
মাহিম মাথা নিচু করে সব শুনে, আর ভাবে, "কিছুই তো হয়নাই তাই এতো কথা, সে তো সোনেলা কে চিনতোই না। সোনেলাই আসলো এক বৃষ্টির দিনে। আর এ কথা সত্য যে সোনেলা তার মনে অনেক যায়গা করে নিয়েছে কিন্তু কখনোই মাহিম এ কথা প্রকাশ করেনাই আর মাহিমের যে ভালোবাসা সোনেলার প্রতি হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্রও সম্পদের লোভ নেই। কারন সে পিএইসডি করতেছে, আগের রেজাল্ট ও সব ভালো, কমপ্লিট হয়ে গেলেই সে কোনো ভালো বেতনের চাকরি পাবে কোনো না কোনো ভার্সিটিতে। কিন্তু এ কথা বৃষ্টিকে বোঝাবে কে।"

বৃষ্টি চিল্লাপাল্লা করে চলে যেতেই, মাহিম তার ব্যাগ গুছিয়ে নিলো, তেমন কিছুই ছিলোনা, বেড থাকলো পড়ে, চাদরটিও নিলোনা। শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, বই খাতা, সার্টিফিকেট, আর গবেষনার জিনিসপত্র, টাকা নিয়ে দুটি ট্রলি ভর্তি করে বের হয়ে এসে কেয়ারটেকার কে দিয়ে বৃষ্টিকে ডাকলো, বললো, আমি এই মুহূর্তে চলে যাচ্ছি চাচার জন্য চুক্তি অনুযায়ী আরো ছয় মাসের অগ্রিম ভাড়ার টাকা এটা দিয়ে দিয়েন। আর আমি স্যরি। অনেক চেষ্টা করেও মাহিম অশ্রু লুকাতে পারলোনা, কারন এই প্রথম সে অনেক বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছে ব্যাবহারে। বৃষ্টিও একটু থতমত খেয়ে গেলো, যে ভুল করেনি তো সে। 


সোনেলার একটু দেরি করে ঘুম ভাংগে। সারাদিন আর ছাদে আসা হয়না, রাতে ছাদে এসে মাহিমকে মেসেজ করে কিন্তু উত্তর নেই। কিছুক্ষণ পর দেখে রুমে তালা খোলা কিন্তু কেউ নেই। তার রুমে ঢুকে আলো জ্বালায় সোনেলা, দেখে বিছানা পাতা, ক্যামেরাটা ঝুলানো, কবিতার একটা খাতা আর ডায়েরি পড়ে আছে। সেই সাথে ছোট্ট একটি চিরকুট, "আজ রাতে ছাদে আসবো বলে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু আর আসা হবেনা তাই স্যরি। আর আমি চলে গেলাম আপনাদের বাসা থেকে, জানি আপনি রুমে আসবেন, তাই চিরকুট টি রেখে গেলাম, আর যা যা রেখে এসেছি সেগুলো আপনাকে গিফট।"

সোনেলা বুঝেনা কি হইছে, কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয়, যেনো বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো তার। কেনো চলে গেলো মাহিম, আজ খুব কষ্ট লাগলো তার। কেনো হাসি খুশি মানুষটা চলে গেলো। সোনেলার বয়স ২৩ বছর কেউ তার জীবনে দু মুহুর্ত আনন্দ দিতে পারেনি, সে বড়লোক বাবার সন্তান তাই দুঃখ কষ্ট তার নেই কিন্তু তার পরেও আরেকটি ব্যাপার থাকে তা হলো ভালো লাগা, গত ১ মাসে মাহিম তার সব ভালো লাগা গুলো পুরন করে দিয়েছে তার সাথে বসে বৃষ্টিতে ভিজেছে যা কেউ করেনাই, তার সাথে রাতে বসে দেখেছে আকাশ কিন্তু আর কেউ তো আসেনি। সোনেলা আরো ভাবে যে সেই বা এই অপরিচিত মানুষের জন্য এতো ভাবছে কেনো, কে সে। কিন্তু না অজানা কারনে সোনেলার দু-চোখে নামে অশ্রুজল। সোনেলার ইচ্ছা হতে লাগলো মাহিমকে ডেকে বলতে কেনো সে চলে গেলো, সোনেলা কি কষ্ট দিয়েছে তাকে। মাহিমকে কাছে না পেয়ে মাহিমের বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো সোনেলা। 

তার পর সে নিচে নেমে এসে বাবাকে বললো, কি হইছে মাহিমের কেনো সে চলে গেলো। মাসুম সাহেব বললেন, জানিনা বৃষ্টির কাছে চুক্তির ছয় মাসের ভাড়া রেখে আজ সকালে নাকি চলে গেছে। সোনেলার দুচোখে জল আর বাধ মানলোনা, সে দ্রুত চোখে হাত দিয়ে চলে গেলো পাশের রুমে। মাসুম সাহেব বড় তাজ্জব হলেন।
মেয়ের পেছন পেছন যেয়ে বললেন কি হইছে মা, ওকি কোনো সমস্যা করেছে।
সোনেলা বললো, "আমি জানিনা বাবা, আমি জানিনা। আমি কেনো কান্না করি তাও জানিনা, আমার বড্ড খারাপ লাগছে, কিন্তু কারন জানিনা, তুমি যাও আমাকে একা থাকতে দাও।"
পরদিন সকাল থেকে সোনেলা আর ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করেনা চোখের নিচে কালি পড়ে, সোনেলাও খুবা তাজ্জব হয়ে যায় যে দুদিনের পরিচয়ে পাগল লোকটা কি তাকেও পাগল বানিয়ে দিয়ে গেলো। এক মাস পার হয়ে গেলো সোনেলা মোটেই ভুলতে পারছেনা মুহুর্ত গুলো, আসলে এই ২৩ বছরের জীবনে কেউই তার জীবনেও আসেনি, কারন সে সবসময় সকলের থেকে স্টাটাস বজিয়ে চলার জন্য কেই বা মিশবে। কিন্তু নিজের বাড়িতে এসে কেউ যখন তার অনুভুতি গুলোকে মূল্যায়ন করলো সে অজান্তেই যে মন দিয়ে ফেলেছে সেটা আগে বুঝিনি, মাহিম চলে যাওয়ার পরেই বুঝেছে।

এদিকে মাসুম সাহেব মেয়েকে নিয়ে টেনশনে পড়ে গেলেন ইয়ার ফাইনালের ছুটিতে এসে মেয়ে এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো। বৃষ্টিকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে সে কিছু জানে কিনা। বৃষ্টি সব খুলে বললো। মাসুম সাহেব বললেন তুমি আগে বলোনি কেনো আমাকে, তোমরা দুজনেই আমার সব। তোমাদের জন্য তো আমি সব উৎসর্গ করে দিতে পারি।
পরদিন মাসুম সাহেব ভার্সিটিতে গেলেন, কিন্তু মাহিমের দেখা পান না। কারন তার থিসিসের কাজ কর্ম সে এক ফাকে আসে আর দিয়ে চলে যায় মাসুম সাহেব যখন যান তখন সে আর থাকেনা। এদিকে বৃষ্টিও বোনের শরীর দেখে টেনশনে পড়ে যায়, তার ও নিজের উপরে খুব রাগ হয়। একদিন মাসুম সাহেবকে যেতে মানা করে সেই যায় সকাল থেকে ডিপার্টমেন্ট এর সামনে দাড়িয়ে থেকে সে মাহিমকে পায়। মাহিম ওকে দেখেই, "না দেখার মতো করে চলে যায় ভেতরে।"
বৃষ্টি অবাক হয়, মাহিম বের হতেই দু হাতে পথ আগলে দাড়ায়, "এইযে মাহিম ভাইয়া, কই যাচ্ছেন?"
মাহিম কথা শুনে খুব তাজ্জব হয়, "বলে আবার কিছু বলবেন স্যরি, আমার ডিপার্টমেন্ট এটা প্লিজ কিছু বলবেন না।"
বৃষ্টি হেসে দেয়, "বলে সেদিনের ব্যাবহারের জন্য স্যরি, আপনি আমাদের বাসায় চলুন"
মাহিম বলে বাইরে আসুন, আর, আমি যাচ্ছিনা আপনাদের বাসায় আর। আমি সকল টাকা পয়সাও পরিশোধ করে এসেছি। আপনি যেতে পারেন। ভালো থাকবেন। মাহিম কথা গুলো বলে জোরের সাথে কিন্তু চোখের জল লুকাতে পারেনা।
বৃষ্টি হা হয়ে যায়,সে বাসায় ফিরে যায়। সোনেলা ঘুমিয়ে আছে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার অপরাধবোধ জেগে উঠে ওর মাঝে, যে ওর জন্যই হাসি খুশি মা মরা বোনটার আজ এই অবস্থা। ও দৃড় প্রতিজ্ঞ হয় সে মাহিমকে নিয়ে আসবেই কারন বোনকে তো সেও ভালোবাসে। সে তার মোবাইল দিয়ে সোনেলার ফটো তুলে, তার পরে আবার পরদিন ভার্সিটিতে যায় মাহিমের। আবার মাহিমকে জোর করে দাড় করিয়ে বলে, দেখুন ভাইয়া, এই ছবি গুলো দেখেন আপনি আমার বোনের এই অবস্থার জন্য দায়ী৷ আপনি যদি আমার আপুকে সুস্থ না করতে পারেন তবে আপুর এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী হবেন আর আমিও কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। প্লিজ। অনুনয় ঝরে পড়লো কন্ঠে।
মাহিম সোনেলার ছবি দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবার। সে বুঝে যায় যে মেয়েটি শুধু তারই ভাবনা চুরি করেনাই নিজের ভাবনাও হারিয়ে ফেলেছে। মাহিম আর সহ্য করতে পারেনা। 
মাহিম আর বৃষ্টি যখন ফিরে আসে, সোনেলা তখনও ঘুমায়। মাহিম তার ফেলে রাখা চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বসে, সোনেলা উঠলে বৃষ্টি বলে আপু মাহিম ভাইয়ের ক্যামেরাটা একটু আনতো, তোর ছবি গুলো দেখি। সোনেলা বলে তুই যা, আমার ভালোলাগেনা।
বৃষ্টি জোর করেই ওকে পাঠায় মাহিমের ফেলে যাওয়া ক্যামেরা আনতে। সোনেলা এসে দরজা খুলেই দেখেমাহিম। সোনেলা চিৎকার করে দরজায় লুটিয়ে পড়ে, মাহিম তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে বিছানায় শুইয়ে দেয়, চোখে মুখে জল ছিটায়।
সোনেলা চোখ খুলেই দু হাত তুলে মাহিম কে ডাকা, মাহিম কে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে সোনেলা। তার ছোট্ট বুকের মাঝে যে অনেক ঝড় বইছে, মাহিম অনুভব করতে পারে পাগলীটা কাপছে।"
সোনেলা বলে, "তুমি আমাকে এমন ভাবে ফেলে চলে গিয়েছিলে কেনো, জানো আমার এই বুকে কেউ আজ পর্যন্ত দাগ কাটেনি আর তুমি পুরো বুকটাই চুরি করে ফেলেছো।"
মাহিম বলে, "এই চলে যাওয়াতেই তো বুঝলাম তুমি আমার কতটা নিয়ে নিয়েছো। আমার সারাজীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া তুমি।"
সোনেলার দুচোখে অশ্রু মাহিম দু হাতের আংগুল দিয়ে মুছে দেয়, নাকে নাক মিশায়, সোনেলার কম্পমান ঠোটে নিজের ঠোট রেখে বলে, "এই পাগলী তুমি আর কান্না করোনা বুকে লাগছে।"
সোনেলা আরো জোরে চেপে ধরে বলে আমাকে এভাবে রাখবে তো সারাজীবন।
মাহিম বলে সোনেলাকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে আর দুজনের মন ভরে ওঠে ঐশ্বরিক ভালোবাসায়, এ যে হারানো ভালোবাসা, কামিনীর গন্ধে চারিদিকে সুশোভিত হয়ে আসছে আর দুই নরনারীর অন্তরের সুবাস তারা দুজনেই পাচ্ছে। বাতাস যেনো পরশ বুলিয়ে দিলো, মাহিম সোনেলাকে বুকের উপর শুইয়ে রেখে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে, আর সোনেলা কথা বলেই চলছে, সে কথা যে ফুরাবার নয়.........।

লেখক সোনেলা আর মাহিমকে দোয়া করেন, এমন সকল অন্তরের ভালোবাসা যে লেখকও উপলদ্ধি করেন।

writter: Md. Abidur Rahman, Institute of Business Administration (IBA) , Dhaka University. 

Wednesday, May 27, 2020

অসমাপ্তের সমাপ্ত গল্প- The Finished Story of an unfinished Goal

সামিয়ার আজ অফিসটা বড় খালি খালি লাগছে কেমন যেনো একবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে চোখে আকুলতা নিয়ে। সম্বিত ফিরে পেলো মোক্তার সাহেবের কথায় উনি আবার খুব হাস্যরসিক মানুষ আর অফিসের সকলের সাথেই খুব আন্তরিক। উনি বললেন কি ব্যাপার মামুনি নিল সাহেব আসেননি বুঝি। সামিয়া হেসে বললো না স্যার তেমন কিছু না কিন্তু নিলয় আজকে আসেনি কেনো।

মুক্তার সাহেব হলেন অফিসের ম্যানেজার, উনি বললেন আজ নিলয়ের খুব জ্বর তাই ছুটি নিয়েছে। সামিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেলো শুনে। ও তাড়াতাড়ি কাজে মনযোগ দিলো আজকের মধ্যে আলফা গ্রুপের ফাইল গুলো দেখে দিতে হবে। সামিয়া নিলয় এরা দুজনেই মুলত প্রথমসারির একটা প্রাইভেট বিজনেস এন্যালাইসিস কোম্পানিতে জব করে। সামিয়া আর নিলয় একই ডেস্কে কাজ করে ওরা রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট সেকশনে। ওদের কাজও অনেক। তবে কাজ যতই হোক সামিয়া আর নিলয় কাজের ফাকে ফাকে নিজেদের গল্প ও শেয়ার করে নিয়েছে। আর অফিসে কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। আর সামিয়া আর নিলয়ের ডেস্কে কাজের প্রচুর চাপ কিন্তু তারা খুবই আন্তরিক আর অন্যান্য দের থেকে ভালো পারফরম্যান্স দেখানোয় কোম্পানির মালিক সোবহান সাহেব আর ম্যানেজার মোক্তার সাহেব তাদেরকে আলাদা চোখেই দেখেন। মোক্তার সাহেব সম্পর্কে সোবহান  সাহেবের বড় চাচা তিনি অফিসের সকলকেই প্রায় তুমি করে বলেন।

সামিয়া নিজে থেকেই বড় হয়েছে বলতে গেলে এক চাচার ঘরে পালিত হয়েছে ছোটোবেলায়। কারন ক্লাস ফাইভে থাকার সময় সামিয়ার বাবা মা সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন তার পর চাচা সকল সম্পত্ত্বি নিজেই ভোগ দখল করেছেন বিনিময় হিসেবে SSC পর্যন্ত সামিয়াকে দেখভাল করেছেন এ কথা তো সকলেই জানে। কিন্তু তিনি এমন ভাব দেখান যে সামিয়ার বাবা মা কিছুই রেখে জাননি। তিনিই কোলে পিঠে করে বড় করেছেন, অবশ্য সামিয়াও মেনে নিয়েছে। ও লেখাপড়ায় ভালো ছিলো। শহরের বড় কলেজে বৃত্তিসহ চান্স হয়ে যায়। HSC এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ এ অনার্স মাষ্টার্স করেছে। আর নিলয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর IBA থেকে পড়াশোনা শেষ করে এই অফিসে চাকরি পেয়েছে। আর চাকরি পাওয়ার পরে দুজন এক সেকশনে হওয়ায় আর নিলয়ের উদাসিন স্বভাবের জন্য সামিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক। কেউ কারো সাথে প্রেম করে এমনটা নয়, কিন্তু অন্যেরা তাই মনে করে। 

তো সেদিন সামিয়া একা হাতেই বলতে গেলে দুজনের কাজ সামলে নেয়। বিকাল ৫ টায় অফিস থেকে বের হয়। ওদের অফিস ইসিবি মোড়ে। সামিয়ার বাসা কুড়িলে আর নিলয়ের বাসা নদ্দায়। সামিয়া আর নিলয় প্রতিদিন এক সাথেই বাসায় ফিরে আসে। সামিয়া নেমে যায় কুড়িলে আর নিলয় নামে নদ্দায়। আজকে কুড়িল পর্যন্ত এসে সামিয়া কি মনে করে নামলোনা। সে নদ্দা এসে নামে। নিলয়ের বাসা সে চিনে। বাসার নিচে এসে নিলয় কে ফোন দেয়।
হেল্লো নিল কই তুমি বাসায়?
"হ্যা সামিয়া বাসায় আজ খুব জ্বর তাই অফিসে যাইনি, কেমন আছো তুমি?"
সামিয়া-"আমি নিচে দাড়িয়ে আছি বাসার তোমাকে দেখতে আসছি"
নিলয় সাথে সাথে বিছানা থেকে উঠে পড়ে ব্যাস্ত হাতে বিছানাটা গুছায়, কারন যা এলোমেলো করে রেখেছে পুরো ইজ্জতের বারোটা বাজা সারা।
যাই হোক তার পরে, সামিয়াকে নিয়ে আসে রুমে। সামিয়া এসে হাত মুখ ধুয়ে বিছানার এক পাশে বসে। নিলয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে কপাল পুড়ছে তাপে। সামিয়া বলে কি তুমি তো আমাকে জানাতে পারতে সকালে।
নিলয় বলে, "তোমার তো অফিস ছিলো, আর তোমাকে জানালে তুমি কি মনে করতে ভেবেই জানাইনি।"
সামিয়া বলে, "নিল তুমি আসলেই যেনো কেমন, আমাকে জানালে কি এমন হতো,, আচ্ছা কি খাইছো সকাল থেকে তুমি?"
নিলয় বলে, আজ তো আর রান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা আর শরীর খুব খারাপ তাই বাইরেও যাইনি, বিস্কুট ছিলো মুড়ি ছিলো তাই খাইছি।
সামিয়া বলে শুয়ে পড় আমি দেখছি, কি করা যায়।
নিলয় বলে, "কেনো তুমি আর কি করবা, যাও বাসায় চলে যাও তুমিও অফিস করে ক্লান্ত, কিছু করতে হবেনা।"
সামিয়া বলে,, "চুপ থাকো, আমাকে উপদেশ দিতে হবেনা।"
নিলয় জানে এর পরে আর কোনো কথাই ও শুনবেনা তাই চুপ চাপ থাকে। 
সামিয়া বাসন কোসন ধুয়ে আলু ভর্তা ভাত চাপিয়ে দেয়, সাথে ডিম ভাজি। হাফ ঘন্টার মধ্যেই সব কমপ্লিট। করে বিছানার পাশে সব ঢেকে রেখে দরজা ভেতর থেকে লক করে বেরিয়ে যায় টেনে দিয়ে। কারন ততক্ষণে নিলয় ঘুমিয়ে গেছে।

নিলয়ের ঘুম ভাঙ্গে সামিয়ার ফোনে, ততক্ষণে রাত ৮ টা বেজে গেছে ও ঘুম থেকে উঠেই চারিদিকে দেখে লজ্জা পেয়ে যায় যে এত্ত কাজ করলো মেয়েটা অথচ তাকে বসতেও বললোনা, খেয়ে গেলেও তো পারতো। আসলে তো ওর ই দোষ অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লো কেনো।
যাই হোক ওদিক থেকে সামিয়া বলে চলছে, "নিল উঠে পড়ো খেয়ে নাও, দেখো ভালো লাগবে, আর শোনো অবশ্যই খাবে কিন্তু আমার দিব্বি।
অনেক উৎকন্ঠা কিন্তু আবেগের সাথে কথা গুলো বলছে, শুনতে মনের ভেতরে ভালো লাগছে নিলয়ের। ২৬ বছর বয়সি এত বড় মেয়ে এমন ভাবে বলছে যেনো কত দিনের চেনা তার, কত অধিকারের সাথে বলছে। নিলয় বললো, " ঠিক আছে সামিয়া খেয়ে নিবো, কিন্তু তুমি চলে গেলে কেনো আমাকে ডাকতে পারতা এক সাথেই খাওয়া দাওয়া করতাম।" 
সামিয়ার কন্ঠে উচ্ছাসের প্রকাশ যেনো কথাটা তার কাছে ভালো লেগেছে, ও বললো, "এবার খেয়ে নাও তো নিল" কাল তো শুক্রবার আবার এসে রান্না করে দিয়ে যাবো।" 
নিলয় বলে "আচ্ছা এসো" এ কথা বলে ফোন রেখে দেয়, ফোনের দুই প্রান্তে থাকা দুটি হৃদয়েই যেনো কাশফুলের পরশ বুলিয়ে গেলো কেউ প্রকাশ করলোনা কেউ বুঝতেও পারলোনা কিন্তু দুজনেরই ঠোটের কোনে ফুটে উঠলো হাসি।

নিলয় হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো, ভাত আলু ভর্তা ডিম ভাজি সব খাওয়ার সময়ই যেনো মনে হচ্ছিলো এতে আলাদা একটা সেন্ট আসছে সামিয়ার। সামিয়ার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই কিন্তু খেতেও বড় আবেগ মনে হচ্ছে নিলয়ের কাছে,,, তাহলে কি সে কোনো অজানা পথে পা বাড়াচ্ছে। অজান্তেই কেপে উঠলো মন, সামিয়া যদি এসব না ভাবে, তাহলে বড়ই খারাপ হবে, সামিয়া খুব ভালো মেয়ে সে অসময়ে যত্ন করছে আর নিলয় কি সব ভাবছে। মনটা বড্ড ছেলেমানুষী করছে মনকে বুঝালো সে।

পরের দিন, আবার সামিয়া এলো আজ সে অতিরিক্ত কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছে। এসে জোর করেই নিলয়ের পরা কাপড় গুলো ধুয়ে নেড়ে দিলো তার পর রান্না করলো। রান্না শেষ করেই গোসল করে সাথে আনা অন্য সেট জামা কাপড় পরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। নিলয়ের জ্বর আজ কম, সে জানে তার জ্বর কখনোই দুই দিনের বেশি যায়না। কাল থেকেই সে অফিসে যেতে পারবে। সামিয়াকে নিলয় বললো "আজ এক সাথে খেয়ে যাও"
 সামিয়া বললো, "না ইচ্ছে হচ্ছেনা।" 
কোনো অনুরোধেই শুনলোনা সে যখন বেরিয়ে যাবে, শেষ বারের মতো নিলয় বললো "সামিয়া আজ এক সাথে না খেয়ে গেলে এগুলো যেমন আছে তেমনই থাকবে।" বলে ডান হাত দিয়ে সামিয়ার বাম হাত টেনে ধরলো। নিলয়ের সারা শরীর সিরসির করে উঠলো কারন সে এভাবে আন্তরিক ভাবে কখনোই ওকে ধরেনাই। অফিসে কাজের ফাকে অনেক সময় ছোঁয়া লাগে কিন্তু এভাবে কখনোই ওর হাত ধরা হয়নাই। নিলয়ের মনে হলো সামিয়াও কেপে উঠলো, ও ফিরে তাকালো যেনো অসীম সাগরের মত এক জোড়া চোখ। ডান হাত ঘুরিয়ে নিজের হাত থেকে নিলয়ের হাত ছুটিয়ে নিয়ে নিজেই ধরলো নিলয়ের হাত বললো "আমি খেয়ে গেলে খুশি তুমি নিল।" 
নিলয় বললো, "খুশি কিনা জানিনা তবে আজ না খেয়ে গেলে আর তোমাকে আসতেও হবেনা আর আমি খাবোওনা এসব।" 
সামিয়া ওর ঠোটের উপর আংগুল রাখে আর বলে চলো খেয়ে নেই।

দুজনে খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর থালা বাসন আবার ধুয়ে দিয়ে সামিয়া চলে গেলো। ওর পাল্টানো কাপড় গুলো ও নিলয়ের ভেজা জামা কাপড়ের পাশে ধুয়ে শুকাতে রেখে গেছে। সন্ধা হতে হতে নিলয়ের শরীর ঝরঝরে হয়ে গেলো। ব্যালকনিতে যেয়ে সামিয়ার কাপড় গুলোর সাথে মিশে দাড়ালো যেনো বড় ভালো লাগছে ওর। এক সময় দুই হাতে জামা কাপড় গুলো আঁকড়ে ধরলো সামিয়ার। নিলয় জানেনা কেনো এমন করছে ও। জামা কাপড় গুলো ইস্ত্রি করে সুন্দর করে ভাজ করে একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো ও। অফিসে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে। 

শনিবার সুস্থই ছিলো নিলয়, এর মাঝে সামিয়া আর আসেনাই তবে ফোনে কথা হয়েছে। রবিবারে অফিসে গেলো নিলয় অফিসে যেতেই শুনলো চেয়ারম্যান স্যার মানে সোবহান সাহেব ডেকেছেন। সামিয়ার কাপড় সুদ্ধু শপিং ব্যাগটা সামিয়ার চেয়ারে রেখে ও দেখা করতে গেলো সামিয়া তখনও আসেনাই। সোবহান সাহেবের রুমে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতেই আন্তরিকতার সাথে সোবহান সাহেব বললেন মোক্তার সাহেব বললেন আপনি অসুস্থ তাহলে আপনি না আসলেও পারতেন আমি তো আপনাকে কখনও আটকাতাম না। নিলয় বললো স্যার আসলে বাসায় থাকতে ভালোলাগেনা আপনাদের সাথে দেখা হচ্ছে এটাই ভালো লাগছে আমার। সোবহান সাহেব হাসি মুখে বললেন আচ্ছা যান তবে বেশি কাজ করার দরকার নেই। 

নিলয় ফিরে এসে তার চেয়ারে বসতেই দেখে সামিয়াও চলে এসেছে। সামিয়া বললো কেমন আছো। নিলয়ের ছোট্ট উত্তর, "ভালো আছি, তুমি কেমন।" সামিয়া বললো ভালো, খাওয়া দাওয়া করতে পারছো। নিলয় সম্মতি সুচক মাথা নাড়লো। টিফিনের সময় অফিস রুমে স্বাভাবিক কেউ খায়না, নিষেধ নেই কিন্তু অফিসের চত্ত্বরটা অনেক সুন্দর আর ওখানে ছাতা দিয়ে ছায়া করা নান্দনিক বেঞ্চ পাতা থাকায় সবাই ওখানেই গল্প করতে করতে খায়। টিফিন আওয়ার শুরু হলেই নিলয় ওয়াশরুমে যায়, আর সবাই বেরিয়ে গেলে অফিশরুম থেকে ও এসে আবার ডেস্কে বসে পড়ে কারন ও টিফিন আনেনাই। মূলত ও বাসায় আজ রান্নাও করেনাই ভালোলাগছিলো না তাই।

এদিকে সামিয়া নিলয়কে ওয়াশরুমে যেতে দেখে বাইরে যেয়ে বসে একটা ফাকা বেঞ্চে,, ওর ইচ্ছা নিলয় বেরিয়ে এলে এদিকে ইশারা করে আসতে বলবে। কিন্তু নিলয় না আসায় সামিয়া আবার অফিসরুমে ঢুকে দেখে নিলয় ওর ডেস্কে বসে আছে। সামিয়া কাছে এসে বলে টিফিন কই নিল?" 
নিলয় বলে খেতে ইচ্ছা করছেনা তো তাই আনিনি। 
সামিয়া এক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বাসা থেকে আনা রুটি আর মুরগির মাংস থেকে, রুটি ছিড়ে মাংস নিয়ে নিলয়ের মুখের সামনে ধরে বলে হা করো তাড়াতাড়ি। নিলয়ের না না বলতে বলতেই মুখে ঠেলে দেয় রুটি মাংস। জোর করে খাইয়ে তার পর পানির বোতল বের করে পানি খাইয়ে হাত ধুয়ে নিয়ে ভেজা হাত দিয়ে নিলয়ের মুখ মুছে দেয় সামিয়া।
ওদিকে রুমে বসে এই ঘটনার সাক্ষি হয়ে যান একমাত্র তৃতীয় ব্যক্তি মোক্তার সাহেব। উনাকে এরা দুজনের কেউ খেয়াল করেনাই। মোক্তার সাহেবের চোখের কোনে কখন জল এসে গেছে তা উনিও জানেন না। এই ৬০ বছরের জীবনে উনি এখনো আবেগ অনুভব করেন একদম বাচ্চাদের মতো। 
★★★★★★★★★★★★★★ ★★★★★★
দিন যায় রাত আসে এভাবেই চলতে থাকে অফিসের কার্যক্রম। এদিকে শেরপুরের এক বিখ্যাত ধনকুবের আলহাজ্ব ইলিয়াস হোসেন তার নেপিয়ার গ্রুপের জন্য কিছু বিজনেস স্পেশালিস্টের পরামর্শ চাইলেন এই অফিসে কারন তার বিজনেস গত বছর থেকে লস প্রজেক্ট হয়ে আছে, অফিস থেকে ইলিয়াস সাহেবের ব্যাবসা ক্ষতিয়ে দেখার জন্য মোক্তার সাহেব নিলয় আর সামিয়াকে নির্বাচন করলেন। তারা উভয়েই তিনদিন ব্যাবসার সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করে আসবে এসে সিদ্ধান্ত জানাবে।
মোক্তার সাহেব অফিস থেকে থাকা খাওয়া আর যাতায়াতের সকল ব্যাবস্থা করে দিলেন যদিও সকল খরচ ইলিয়াস সাহেব দিয়ে দিবেন ওরা গেলেই। 
ওরা ওদিনই ছোট্ট শহর শেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ভাড়া করা ট্যাক্সিতে। তবে প্রচুর বৃষ্টি শুরু হলো যাত্রা শুরু করতে করতেই। আর রাস্তা এতোই খারাপ সেই সাথে বৃষ্টি হওয়ায় মারাত্নক জ্যাম। সন্ধা ৭.৩০ এ রওনা হকেও টঙ্গী ছাড়াতেই ১০ টা পার হয়ে গেলো। তার পরেও রাস্তায় জ্যাম গাড়ি থেমে থেমে যাচ্ছে। ওদিকে জানালার কাচের উপর দিয়ে জল নামছে সবেগে। জানালার কাচে মাথা রেখে তাই অনুভব করছে সামিয়া। আর নিলয় বসে বসে দেখছে, খুব ভালো লাগছে তার রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোয় সামিয়ার মুখ সে ভালোভাবে দেখতে না পারলেও অবয়বটা বুঝতে পারছে। কিছুক্ষন পরে সামিয়া বললো নিল আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, বলেই নিলয়ের পায়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো সামিয়া। নিলয় চুপ করে দেখলো, আস্তে করে সামিয়াকে ধরে রাখলো যাতে পড়ে না যায়। খুব ভালো লাগছে ওর সামিয়াকে ফিল করতে। মনে হচ্ছে যেনো জড়িয়ে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে কিন্তু সাহস হচ্ছেনা আবার সেই সাথে অজানা বাধা অনুভব করছে।

তবে দেখতে তো আর কেউ বাধা দিচ্ছেনা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে নিলয়ের পায়ে। ঘুমের মধ্যেই সামিয়া কাত হয়ে নিলয়ের পিঠের পেছনে হাত দিয়ে আকড়ে ধরলো ঘুরে। নিলয় সামিয়ার চুল লম্বা চুল গুলো যাতে গাড়ির মেঝেতে না চলে যায় তাই গুছিয়ে হাতে ধরে সামিয়ার পিটের উপর দুই হাত দিয়ে ধরে রাখলো যাতে ঝাকিতে ও গড়িয়ে পড়ে না যায়।। সারা রাত এভাবেই কেটে গেলো। রাত তিনটা বেজে গেলো পৌঁছাতে। শেরপুর নিউমার্কেট চত্ত্বরে পুলিশ বক্সের পাশে গাড়ি রেখে ঐ রাতে কেউ নামলোনা। ওখানেই থাকলো। সকাল হতেই ইলিয়াস সাহেবের লোকেরা এসে হোটেল 'আয়সার ইন' এ ওদের জন্য দুটি ভি আইপি AC রুমের চাবি দিয়ে গেলো। নিউমার্কেট থেকে একটু আগেই হোটেলটি। 
ওরা সকালে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই শাহজাহান হোটেলের ভুনা খিচুড়ি চলে এলো। নেপিয়ার গ্রুপের কর্তারা মূলত ওদের বেশ যত্ন আত্তি করছে। শেরপুর শহরে অনেক ঘুরার যায়গা আছে সুযোগ হলে ঘুরাফিরার ইচ্ছা আছে।

প্রতিদিন সকাল ৯টায় অফিসে যায় আর ওদের অডিট কার্যক্রম চলে দুপুর ৫টা পর্যন্ত। এই অফিস থেকেই দুপুরে নাস্তা দেয় তার পর অফিস থেকে বের হয়ে ওরা হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তার পর সামিয়া বলে নিল চলো একটু ঘুরে দেখি শহরটা। নিলয় বলে চলো, সামিয়া আজ পরেছে একটা লাল ফুলের প্রিন্ট ওয়ালা সাদা শাড়ি আর নিলয় পরেছে জিনস প্যান্ট আর সাদা শার্ট। ওরা আইসার ইন থেকে হাটতে হাটতে নিউমার্কেটের সামনে এসে দুই কাপ চা খেয়ে একটা ইঞ্জিনের রিক্সা ভাড়া করলো প্রতি ঘন্টা ১৫০ টাকা চুক্তিতে, ও শেরপুর শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। ছেলেটার বয়স কম নাম জিজ্ঞাসা করতেই বললো ভুলু মিয়া। বেশ হাসি খুশি, ও বললো স্যার, "ম্যাডামকে মানিয়েছে ভালোই আপনার সাথে,"  নিলয় কিছু বলতে গেলো, কিন্তু সামিয়া বললো থাক ও বলছে বলুক। ওরা ঘুরতে ফিরতে ভুলু মিয়ার গল্প শুনছে। ও এক এক যায়গায় রিক্সা থামায় আর বলে এখানে এটা বিখ্যাত এই এর ইতিহাস, দেখলাম ভালোই জানে। রঘুনাথ বাজারে সত্যবতী সিনেমা হলের পাশে মাশরুম এর চপ, চকবাজারের রুপকথা হলের সামনের চা, খোয়াড়পাড়, শ্রিবরদি বাজার রোডের লিখন হলের সামনের মিষ্টি পান। তেরোবাজার মোড় থেকে হামিদ ভাইয়ের লাড্ডু, চারু সুইটস এর সব মালাই চাপ খেয়ে ওরা রাত ১০ টার দিকে হোটেলে ফিরে এলো। 

সামিয়া খুবই ক্লান্ত। ওরা যার যার রুমে ঢুকে গেলো, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে সামিয়া বেরিয়ে এসে নিলয়ের দরজায় নক করলো, নিলয় দরজা খুলে দিলে ভেতরে এসে বললো কিছু ভাল্লাগছেনা নতুন যায়গা একা একা। নিলয় বললো তাইলে টিভি দেখো দাড়াও নিচে থেকে কিছু কিনে আনি৷ ও নিচে গিয়ে চিপস কিনে নিয়ে এলো সাথে মিরিন্ডা আর কিছু চকলেট-কিটক্যাট এইসব।

ওরা গল্প করতে লাগলো, নিলয়ের কেমন ঘোর ঘোর লাগছিলো কারন সামিয়ার গোসল করে আসার পর থেকে ওর চুলের শ্যাম্পুর একটা সুবাস পাচ্ছিলো ও। আর সামিয়া ওর গায়ের কাছাকাছি বসায় সেন্টটা আরো ভালোভাবে ফিল করছিলো। একসময় সামিয়া বালিসে হেলান দিয়ে বসলো নিলয়ের দিকে পা দিয়ে। সামিয়া কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো, নিলয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো গালটা একটু ফাকা হয়ে আছে, চুলগুলো মুখে এসে পড়েছে কেমন যেনো খুব বাচ্চা বাচ্চা লাগছে মেয়েটাকে। নিলয় ওর পায়ের দিকে ছিলো, আর ঘুমের ভেতরে দুই পা প্রসারিত করে নিলয়ের কোলের উপর তুলে দিলো। নিলয় দু হাত দিয়ে পা দুখানি ওর কোলে রেখে নিজে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো। দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো গভীর ঘুমে, ঘুমিয়ে নিলয় সপ্ন দেখলো ও আর সামিয়া শুয়ে আছে কোথাও পাশা পাশি, ওদের চারিদিকে স্বর্ণলতার বেয়ে উঠেছে। কিছু জংলী ফুল ফুটেছে ওদের দুজনের উপরে স্বর্ণলতিকার সাথে।

সকাল বেলা সামিয়ার ঘুম থেকে উঠলো আগে, অনেক ক্লান্তি থাকায় কেউ রাতে নড়েনি, সামিয়া দেখলো ওর পায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে নিলয়, নিলয়ের পেটের উপর ওর দুই পা। সামিয়ার মুখে ফুটে উঠলো একটু হাসি, সে হাসি যেনো ভালোলাগার। কেউ সে হাসির সাক্ষি থাকলোনা। ও নিলয় কে জাগিয়ে তুললো, নিলয় উঠেই বললো স্যরি, কোনো সমস্যা হয়নাইতো তোমার। 
সামিয়া বললো সমস্যা তো তোমার হইছে আমার পায়ের দিকে শুইলে কেনো, আর আমাকে তো জাগিয়ে দিতে পারতে তোমার পেটের উপর আমি পা তুলে শুয়ে ছিলাম নিল স্যরি। 
নিলয় বললো আমি কিছু মনে করিনি সামিয়া, বরং তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। 
সামিয়া ফিক করে হেসে দিলো, বললো কি যে বলো, ভালো লাগবে কেনো, আমি দেখতে মোটেই সুন্দর না। 
নিলয় বললো, না আমার চোখে খুব ভালো লাগছিলো আর  মনে হচ্ছিলো....... 
সামিয়া বললো কি মনে হচ্ছিলো? 
নিলয় বললো, তুমি রাগ করবে বললে, থাক স্যরি। 
সামিয়া বললো "না হবেনা, তোমাকে বলতেই হবে, আমার দিব্বি।"
নিলয় মাথা নিচু করে লজ্জাবনত চোখে বললো, আমার খুব মনে হচ্ছিলো যে তোমার দুই গালে দুটা চুমু দেই। 
সামিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, আর মনে মনে বললো দিতে ইচ্ছা হচ্ছিলো দিতে, আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম কিছুই তো বলতাম না। কিন্তু লেখক এটা বুঝে গেলেন যে সামিয়া যদি এদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখতো তবে নিলয় সামিয়ার ঠোটের কোনে হাসির ঝিলিক দেখতে পেতো।।

যাই হোক, একে একে তিনদিন কাজ ও শেষ হলো আর সেই সাথে বিদায়ের পালা শেরপুর থেকে।  নেপিয়ার গ্রুপের সকল হিসাব পাতি দেখে ওরা বুঝতে পারলো যে কোম্পানির ম্যানেজারের দুই নম্বর কার্যক্রম ই কোম্পানির লসের জন্য দায়ী। নেপিয়ার কোম্পানির চেয়ারম্যান ইলিয়াস সাহেবের সাথে গোপনে বৈঠক করে ওরা ওদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলো। ইলিয়াস সাহেব খুবই কঠোর মানুষ। উনি খুবই খুশি হলেন কাজের প্রতি। ওদের চুক্তির টাকা বুঝিয়ে দেয়ার পরে আরো কিছু সম্মানি দিলেন হিসেবের বাইরে। 

ওরা এবার বাসে টিকিট কাটলো শেরপুর নিউমার্কেট থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৬ টায় বাস, AC -Delux. এর। সেদিন ওদের মাথায় চাপ কম,, সন্ধায় শেরপুরের বিখ্যাত অনুরাধার দই খেয়ে ওরা ফিরে এলো মাইসাহেবা মসজিদের সামনে। এখান থেকে ঘুরে ফিরে ওরা কিছু শপিং করলো। শপিং বলতে গেলে একে অপরকে করে দেওয়াই হলো। নিলয় শেরপুর থেকে কিছু গারো উপজাতিদের তৈরি গিফট আইটেম শো পিস কিনে দিলো সামিয়াকে, সেই সাথে একটা নীল রং এর শাড়ি। আর সামিয়া কিনলো একটা সাদা পাঞ্জাবী আর একটা বাঁশের বাঁশি। কিনে নিলয় কে দিলো। কেনা কাটা শেষ হলে ওরা একটা রিকশায় উঠে ফিরে এলো হোটেলে, রিক্সায় উঠে নিলয়ের হাতের আংগুলের ভেতরে আংগুল ঢুকিয়ে বসে থাকলো সামিয়া। আকাশে আজ মেঘ নেই, চাদ উঠেছে চকচকে সামিয়া উপর দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় বললো সামিয়া পড়ে যাবা তো। সামিয়া উদাস সুরে বললো, কেনো নিল তুমি আমাকে ধরে রাখতে পারবানা। নিলয় কিছু না বলে দুই হাত দিয়ে সামিয়ার দুই হাত মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে কোলে টেনে নিলো, সামিয়া কিছুই বললোনা।

পরের দিন সকাল ৬ টায় ওরা বাসে উঠলো, সাড়ে ছয়টায় বাস ছাড়লো। ১২ টার মধ্যে ঢাকা পৌছে গেলো বাস। ওরা ওদের অফিসে যেয়ে টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিলো আর রিপোর্ট দিলো কাজের। সোবহান সাহেব খুব খুশি হয়ে দুজনকে বোনাস দিলেন। আর বললেন আজ আপনাদের ছুটি, ট্যুর করে এসেছেন বাসায় যেয়ে বিশ্রাম নেন। 
ওরা অফিস থেকে বের হয়ে বাসে উঠে, কুড়িল পৌঁছে সামিয়া নেমে যায় আর নিলয় নদ্দায় নামে। কিন্তু আজ আর বাসায় যেতে মন চাইছেনা নিলয়ের। কি মনে করে সামিয়াকে ফোন দেয় নিলয়,,, "হেলো সামিয়া কি করো তুমি"
সামিয়া বলে, "এইতো নিল বাসায় আসলাম, কি হইছে তোমার।"
নিলয় বলে, " তুমি আসতে পারবা আজকেই আমার বাসায় একটু।"
সামিয়া বলে, "হ্যা পারবো, তাহলে গোসল করে আসছি।"
নিলয় বলে, "আচ্ছা আসো।"
১ ঘন্টা পরে সামিয়া এসে দেখে নিলয় বাসায় না উঠে নিচে দাড়িয়ে আছে, সামিয়া আশ্চর্য হয়ে বলে "সেকি তুমি ফ্রেশ না হয়ে দাড়িয়ে আছো কেনো?"
নিলয় বলে কি করবো বলো, ভালোলাগছেনা, জানিনা কেমন যেনো লাগছে।
সামিয়া বলে, পাগল হয়ে যাচ্ছো দিন দিন, চলো উপরে যাই।
নিলয় রুমে এসে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকলো, ওদিকে সামিয়া চুলায় রান্না বসিয়ে দিলো। নিলয় ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো, সামিয়া একে একে ফ্রিজে রাখা মুরগির মাংস রান্না করলো আর ভাত রান্না করলো। তার পর দুজনেই খেতে বসলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সামিয়া বললো আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসো এবার রাত হয়ে গেছে। নিলয় বললো চলো। 
সামিয়ার ফ্লাটে এসে লিফট থেকে নেমে সামিয়ার রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে নিলয় সামিয়াকে বলল এবার তাহলে যাই। সামিয়া বললো আচ্ছা যাও। আজ তো বৃহস্পতিবার মানে কাল পরশু অফিস এমনিতেই ছুটি। "ওকে" বললো নিলয় কিন্তু যাচ্ছেনা, সামিয়া বললো কি হলো যাবেনা ফিরে না-কি। নিলয় বললো হ্যা যাবো, কিন্তু না' নিলয় যাচ্ছেনা সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিয়া কি মনে করে কাছে আসলো নিলয়ের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকায় দিয়ে নিলয় কে দরজার সাথে সেটে ধরলো, তার পর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো সেদিন তোমার কি ইচ্ছা হচ্ছিলো নিল। নিল কিছুই বলছেনা। সামিয়া বুকের সাথে আঁকড়ে ধরলো নিলয়কে, আর নিলয়ের ঠোটে নিজের দুই ঠোট লেপ্টে ধরলো। অনেক্ষণ হয়ে গেলো নিলয়ও সামিয়ার পিঠে হাত রেখেছে বড্ড ভরশার ছোঁয়া সে হাতে। সামিয়ার ঠোট থেকে নিজের ঠোট ছাড়িয়ে সামিয়ার কপালে, দুই চোখে আর মাথায় চুমু খেলো নিলয়। তার পরে নিলয় সামিয়াকে বললো "আমরা কি এক বাসায় থাকতে পারি, আমার না খুব ইচ্ছা তোমার হাতে হাত রেখে চাঁদ দেখবো, দেখবো ঝুম বৃষ্টি, তোমাকে কোলে তুলে তোমার ঠোটে চুমু খাবো। আর তুমিও আমার গলা জড়িয়ে ধরে থাকবা। দুজনে হাতে হাত রেখে ঘুরবো বোটানিক্যাল এ। 
সামিয়া বললো হ্যা নিল আমরা পারি, আমি ও তোমার চোখে চোখ রেখে দেখতে চাই চাঁদ, তোমার বুকে মাথা রেখে কাটাতে চাই প্রতিটি মুহুর্ত। আমি তোমার হাত ধরে হারিয়ে যেতে চাই দুর অজানায়। প্রতিদিন খাইয়ে দিতে চাই তোমাকে নিল। বলে আবারো নিলয়ের মুখে চুমু খেলো সামিয়া। 

পরিসমাপ্তিঃ

মোক্তার সাহেব, সোবহান সাহেব আর সকল কলিগদের দাওয়াত করা করলো নিলয় তার এক বন্ধুর কমিউনিটি সেন্টার আব্দুল্লাহপুরে। পরদিন জুম্মা বাদ সবাই একে একে এলো, সোবহান সাহেব স্বপরিবারে এসেছেন, মোক্তার সাহেব এসেছেন আরো সবাই এসেছেন নানা ধরনের গিফট নিয়ে। অফিসের মেয়ে কলিগেরা গেলো সামিয়াকে নিয়ে আসতে। সামিয়ার সেই চাচা ও এসেছেন। কনে সামিয়াও চলে এসেছে। এদিকে নিলয়ের দেখা নেই, ২ টা পেরিয়ে ৩টা ৪ টা বেজে গেলো নিলয়ের দেখা নেই। ৪.১৫ নাগাদ মোক্তার সাহেবের ফোনে একটা অচেনা নাম্বারের কল আসলো উনি রিসিভ করতেই বললো আমি ভাটারা থানা থেকে বলছি। নিলয় নামে কেউ কি আপনার অফিসের এমপ্লয়ি আপনার কার্ড পাওয়া গেছে উনার মানিব্যাগ থেকে। মোক্তার সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন হ্যা কি হয়েছে ওর। ওপাশ থেকে বললেন নিলয় সাহেব সম্ভবত কোনো অনুষ্টানে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন সাথে ছিলেন উনার মামা, এয়ারপোর্ট রোডে পাশ থেকে লেন চেঞ্জ করে এক ট্রাক দুজনকে উনাদের গাড়ি সুদ্ধু চাপা দিয়েছে সাথে ড্রাইভার ও নিহত হয়েছে। 

মোক্তার সাহেব কিছু বললেন না, ফোন সোবহান সাহেবকে দিয়ে দিলেন। সোবহান সাহেব ক্ষমতাশালী মানুষ উনি নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিশকে অনুরোধ করলেন এম্বুল্যান্স এ করে পাঠায় দেয়ার জন্য এই কমিউনিটি সেন্টারে। আর কাউকে কিছুই এ দুজন বললেন না, সামিয়া বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলো নিলয়ের নাম্বারে ফোন যাচ্ছেনা কেনো। কখন আসবে ও, আপনারা কিছু বলছেন না কেনো। মোক্তার সাহেব বললেন মামুনি একটু অপেক্ষা করো আসছে নিলয়। কিছুক্ষণ পরে এম্বুল্যান্স এলো বের করা হলো একটি কফিন সবাই নিচে নেমে গেলো। কফিনের মুখ খুলতেই চারিদিকে একটা শোরগোল পড়ে গেলো, এম্বুল্যান্স এর ড্রাইভার বললো সমগ্র শরীর নষ্ট হয়ে গেছে শুধু মুখটাই ভালো আছে আর কিছুই দেখার মতো নেই। সামিয়া এক বার তাকিয়েই কফিনের উপর পড়ে গেলো মেয়ে কলিগেরা টেনে তুললো মুখে চোখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা হলো অনেক, কিন্তু না জ্ঞান ফিরলোনা।

এম্বুল্যান্স এর সাথে আসা ডাক্তার বললেন, ওর জ্ঞান আর ফিরবেনা। সকলের অশ্রুজল মিশে গেলো, তিনটি লাশ - নিলয়ের মামা, নিলয় আর তার পাশে সামিয়ার লাশ পাশাপাশি রাখা হয়েছে, দুটি এসেছিলো আর একটি বেড়ে তিনটি হয়েছে। নিলয় দের নিহত ড্রাইভারকে আগেই ড্রাইভারের গ্রামের বাড়ি পাঠায় দেয়া হয়েছে।

সোবহান সাহেবের একক তত্ত্বাবধানে তিনজনের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো নিলয়ের গ্রামে, নিলয়ের বাবা মা সহ অনেক আত্নীয় স্বজনের লাশ এখানে দাফন করা হয়েছে। নিলয়ের পাশে সামিয়ার লাশ দাফন করা হলো। মোক্তার সাহেব, সোবহান সাহেব সহ সকল কলিগ এবং গ্রাম বাসির চোখের জলে সিক্ত হলো নিলয়ের আর সামিয়ার লাশ। গ্রামের গৃহবধুরাও অশ্রু বিসর্জন করলেন, দুটি হৃদয় সামাজিক বন্ধন প্রতিষ্টিত না হলেও যে বন্ধন প্রতিষ্টিত হয়েছিলো তা ছিন্ন করতে পারিনি তাই নিলয়ের লাশ দেখেই সামিয়ার হার্ট ফেইল হয়ে গেছিলো। কবর দেয়া শেষ সবাই হাত তুলে দোয়া করলো, সোবহান সাহেব ওদের দুজনের কবর ঘিরে দিলেন নিজ খরচে। কিছুদিন পরে দুই কবর দেয়াল পেচিয়ে উঠলো স্বর্ণলতা। আরো ফুটলো নানা ধরনের জংলি ফুল। 
সবাই ভুলে গেলো একে একে,,,সামিয়া-নিলয়ের অফিসের ডেস্কে যারাই বসেছে তারাই শুনেছে তাদের গল্প। তারাও ভাবে তাদের কথা, বিয়ের কনে আর বর দুই কপোত কপোতির বিয়ের সাজে কফিন বন্ধি হওয়ার গল্প। বিবাহবার্ষিকী হয়েছে তাদের মৃত্যুবার্ষিকী। 

যারা কবর খুড়তে আসে তারা ঐ কবর দুটির দিকে তাকিয়ে অজান্তে ঝরায় অশ্রু। আরো দুজন আছেন মোক্তার সাহেব আর সোবহান সাহেব, প্রতি বছর আসেন এই কবরস্থানে সেই বিবাহবার্ষিকীতে, সাথে আসে আরো কিছু মানুষ যারা নিলয় আর সামিয়ার সাথে চাকরি করতো। যারা নতুন এমপ্লয়ি তারাও কেউ কেউ আসে গল্প শুনে দুই অতৃপ্ত মানব মানবীর সমাধি দেখতে। নিলয় আর সামিয়ার ভালোবাসার অশ্রু জল সিক্ত করে দিলো লেখককেও, লেখকের একান্ত কামনা আর কোনো সামিয়া-নিলের যেনো এমন ভাগ্য না হয়। নিল আর সামিয়ার বিবাহবার্ষিকী এভাবেই ফিরে ফিরে আসে আর পালিত হতে থাকে অশ্রুজলে।

★Writter: Md. Abidur Rahman, MBA (Regular programme)  From. Institute of Business Administration, Dhaka University