দিনটা ছিলো ঝড়ের, পাপ গ্রহের পাপ ঘন হয়ে এসেছিলো। তাই পৃথিবী জুড়ে ঘনিয়ে এসেছিলো নিকষ কালো মেঘ। তারই সাথে এসেছিলো দমকা হাওয়া, মুহুর্মুহু গর্জনে চারিদিক প্রকম্পিত হচ্ছিলো। সব যেনো থমকে গিয়েছিলো অজানা আতংকে, বৃক্ষ দেবী অনেক চেষ্টা করেও রুখতে পারছিলোনা বাতাসের তান্ডব। কি শুরু হলো, একি মহাপ্রলয়ের ঘনঘটা?
সমগ্র প্রকৃতি যখন তাল মিলাচ্ছিলো ঝড়ের সাথে, ফুঁসে উঠেছিলো মহাসমুদ্রের নোনা দিগন্ত বিস্তৃত জল। এরি মধ্যে কেপে কেপে উঠছিলো আরো একটি অন্তর৷ সুন্দরবনের পাশ ঘেষে বসবাস করা জেলে পরিবারের নববঁধূ মেঘা। তার মা বাবা ও কেউ নেই। মা বাবার কথা তার মনে পড়েনা, শুধু মনে পড়ে তার আবছায়া ভাবে সেদিন কোনো এক মানুষ তার মায়ের সাথে কিছুক্ষণ বিছানায় ছিলো পরে তাকে গলায় গামছা দিয়ে ঝুল খাওয়ার জন্য টিনে বেধে দিয়েছিলো। তখন কিছুই বুঝিনি সাড়ে চার বা পাঁচ বছরের মেঘা, তবে খুব কেঁদেছিলো তখন সে। তখন থেকেই গ্রামের যার তার হাতে খেয়ে মানুষ এই মেঘা। গ্রামের সবাই বলে তোর মা বড় অপয়া ছিলোরে মেঘা, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্নহত্যা করেছিলো।
পাড়ার বখাটে গুলো খুব জ্বালাতন করা ধরেছে মেঘাকে, যেদিন থেকে যৌবণের ফুল তার শরীরে ফোটা ধরেছে সেদিন থেকেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিলো গ্রামের মেম্বারের ছেলে মধু। জেলে পরিবার গুলোর দাবী ছিলো এই এলাকার সবাই জেলে, বাইরের ধনী মানুষ আমাদের সমস্যা বুঝবেনা তাই মেম্বার হবে আমাদের থেকে। কে শুনে কার কথা, টাকার দৌলতে আজকে এলাকার মেম্বার প্রভাবশালী এক ব্যাবসায়ী, তার চাউলের আড়ত আছে সাতক্ষীরা শহরে, ঢাকা সহ অন্যান্য জেলায় যায় তার মাছের ট্রাক। গ্রামের অভাবী জেলেদের অভাব মেটানোর জন্য তিনি মেম্বারের মহান দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এতে অবশ্য কোনো জেলের ভাগ্যের পরিবর্তনই হয়নাই বরং তার ব্যবসায় আগে ভাড়ার ট্রাক ছিলো এখন নিজস্ব ট্রাক ১০ টি।
এখন মেঘার বয়স ১৪ বছর, সেদিন এক চৈত্রের বিকালে নদী থেকে গোসল করে আসার সময় মধুর সাথে দেখা। মধু তাকে বলে মেঘা তুই তো খুব বড় হয়ে উঠেছিস, তুই আমার বাড়ি আসবি আজকে রাতে। সে খুব ভয় পেয়ে আব্বাসউদ্দীন এর বাড়ি যায়৷ এই আব্বাসউদ্দীন এর বাড়িই মেঘার আবাসস্থল, মা মারা যাওয়ার পর থেকে। কারন তার মায়ের বাড়ির ঝুপড়ি পাকা ইটের করে, মেম্বার দিয়েছেন চাউলের দোকান, এলাকার মানুষের যাতে করে চাউল আনতে আর শহরে যেতে না হয়।
সেদিন ফিরেই, আব্বাসউদ্দীন কে সব খুলে বলে, শুনেই তিনি বলেন মা তুমি আমার মেয়ের মতোই, আমরা জেলে পরিবার কিছুই নেই, আমার বৌ ও নেই। তুমি আমার ছেলে জামালুদ্দিন কে বিয়ে করবা মা। মেঘা তখন ভেবেছিলো, ছোটো বেলা থেকেই জামালুদ্দিন তার জন্য পুতির মালা নিয়ে আসতো, ওমন ছোট্ট মন তাতেই খুশি হয়ে যেতো। একবার তার পায়ে বটি লেগে কেটে গেলে সে কি কান্না জামালুদ্দিন তখন কত ভালোবেসে পট্টি দিয়ে দিয়েছিলো তার পায়, নিজের কোলে মেঘার পা দুটিকে নিয়ে বসে ছিলো, তখন মেঘার বয়স ১১ পেরিয়ে ১২ ছুঁইছুঁই। মেঘার দুচোখে কান্না এসে গিয়েছিলো।
সে বললো চাচা তুমি আমাকে ছোট বেলা থেকে মানুষ করেছো এখন তুমি যা বলো আমি রাজি আছি। আব্বাসউদ্দীন সেদিনই হুজুর ডেকে বিয়ে দিয়ে দিলেন দুজনকে। ওদিকে মেম্বার খবর পেয়ে পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন বিশেষত মধু খুব উত্তেজিত ছিলো কেনো বাল্যবিবাহ দেয়া হলো, সে যাই হোক, শেষমেশ আব্বাসউদ্দীন কে নিয়ে গেলো জেলে। ৬ মাস পরে নাকি ছাড়বে।
দুদিন হয়ে গেছে বিয়ের, জামালুদ্দিন আজকে গেলো নদীতে, পশুর নদী যেমনি উত্তাল তেমনি ভয়াবহ, তার উপরে ঝড় যেভাবে উঠেছে, জেলে পরিবারে বেড়ে উঠা মেয়ে মেঘা ভালোই বুঝে এতে নদীর অবস্থা কি হবে। এদিকে তার চিন্তা অপরদিকে একা বাড়ি টিনের চাল চটার বেড়ার ঘরে বসে ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছিলো, হাত দুখানি দেখছিলো মেন্দির লাল রঙ কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। এমন সময় দরজার শিকলে টান, মেঘা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ভাবলো মনে হয় তার বর ফিরে এসেছে। কিন্তু দরজা খুলেই সে দেখে মধু দাড়িয়ে আছে। মেঘা ভয় পেয়ে দরজা লাগিয়ে দিতে যায়, কিন্তু ততক্ষণে সে ঢুকে গিয়েছে। শ্লেষ মাখা সুরে মধু বলে কি খবর মেঘা, হাতে মেন্দির লাল রং মাখালেই কি হয়, এতে তোকে মানায়না, তোকে মানাবে গয়না সাজালে৷ তুই আমার বাড়ি আসবি তোকে রাজরানী করে রাখবো। মেঘা বলে লাগবেনা মধু ভাই গয়না, তুমি যাও। মধু বলে আরে বলে কি মেয়ে ঝড়ের রাতে কাউকে বের করে দেয় নাকি। তোর মাও আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিলো আজ থেকে ১০ বছর আগে, সে পারেনি আর তুমি কিভাবে পারবে।
সব পরিস্কার হয়ে যায় মেঘার কাছে। কি করে পারবে সে অমন বড় একটা পুরুষের সাথে আর এসময় তার সাথে আছে খোদ শয়তান। মেঘার ব্লাউজ ছিন্ন হয়ে যায়, শাড়ি লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে তার প্রথম দিককার চিৎকার চাপা পড়ে যায় ঝড়ের তান্ডবে। তার ইজ্জৎ আজ লুন্ঠিত হয় মধু নামক এক নরপশুর দ্বারা। রক্তাক্ত হয়ে যায় জামালুদ্দিন দের বিছানার চাদর। মেঘার চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে তার ই ব্লাউজ মুখে ঢুকানোর জন্য। ঘন্টাখানিক একজনের কামপিপাসা মিটাতে যেয়ে মেঘা অজ্ঞান হয়ে যায় যন্ত্রনা, আর মানসিক চাপে। তার পরে সব ঝড় থেমে যায় ঘরের ভেতরের। হাতের মেন্দির লাল রঙ ফিকে হলেও, যেনো নতুন করে দেয়া মেন্দির লালে লাল হয়ে গেছে মেঘার সারা দেহ।
তারপর, মধু খুটে নেয় মেঘার লুন্ঠিত শাড়ি, প্রায় জ্ঞানহারা মেঘার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দেয় মধু, শরিরে তার অসুরের শক্তি। তার উপরে মেঘার সব শুষে নিয়ে মধু এখন প্রকৃত পুরুষ হয়ে গেছে। মেঘার জ্ঞান একটু একটু ফিরে আসে তখন সে নির্মিলিত চোখে দেখতে পায় তার মাকে, যে টিনের সাথে ঝুলে রয়েছে। হাসি ফুটে উঠে মেঘার মুখে। সে শুধু অস্ফুটে বলে আল্লাহ তুমি সব কিছুর সাক্ষী। তার পর সব শেষ মেঘার মাথাটি একদিকে ঝুলে পড়লো তারই অবগুন্ঠন শাড়ির সাথে। সব নিশ্চিত করে মধু বেরিয়ে এলো বীরের বেশে।
আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরে এলো মধু, মধুর বাবা বললেন এই ঝড়ে কোথা থেকে এলি, এমন সময় কেউ আসে, ঝড় থামলে আসবি বাবা। মধুর মা বললো আয় তাড়াতাড়ি উঠে আয় কল থেকে পা ধুয়ে, কাপড় পাল্টা নয় ঠান্ডা লেগে যাবে। এবার তোকে একটা বিয়ে দিয়ে দিবো বয়স তো অনেক হলো। মধু এসব শুনতে শুনতে কলতলা গেলো হাত পা ধুতে। এমন সময় ঝড়ের তান্ডব আরো বেড়ে গেলো। কলের পাড়ে দাড়িয়ে থাকা শতবর্ষি আমগাছের সবচেয়ে বড় ডালটি ভেংগে পড়লো মধুর উপরে, শুধুমাত্র একবার ও মা বলে উঠলো তার পরেই সব চুপ।
ঝড় থেমে গেছে সন্ধা জেঁকে বসেছে চারিদিকে। মধুর মা-বাবা হাত পা ছুড়ে আল্লাহকে দোষারোপ করতে লাগলো ছেলের লাশ সামনে নিয়ে, আমাদের একমাত্র ছেলেকে ছিনিয়ে নিলে ওমন ছেলে কার ভাগ্যে জোটে, আল্লাহ তুমি এইটা কেমনে করতে পারলে। পাড়া প্রতিবেশিরা শান্তনা দিতে দিতে বললো আহা মধু কতো ভালো ছিলো।
ওদিকে ঝড়ের পরেও জামালুদ্দিন আর কোনোদিন ফিরে আসেনাই, নদী তার উদার বক্ষে তাকেও টেনে নিয়েছে হয়তো এজন্যই যাতে ঘরে ফিরে তাকে দেখতে না হয় প্রীয়তমা বৌ টাকে।
গ্রামে তখন চলছে মধুর জানাজা, আর মেঘার জন্য ধিক্কার। কুলহারা মেয়ে নববঁধু মেঘা অপয়া হয়ে মারা গেলো! আত্নহত্যা করেছে! ছি ছি কি কলঙ্ক গ্রামে, তাই তার দাফন কাফন হবেনা। শেষমেশ এলাকার মনু পাগলা আর তার একমাত্র ভাতিজা কাশেম মিয়া সাদা কাপড়ে পেচিয়ে মেঘার লাশ নিয়ে গেলো ঝড়ের পরের শান্ত পশুর নদীতে। নদীবক্ষের উদারতায় হারিয়ে গেলো মেঘার ধর্ষিত দেহ। এখানেই হারিয়ে গেছে মেঘার প্রীয় জামালুদ্দিন।
Writer: Md. Abidur Rahman,
Institute of Business Administration- DU)
No comments:
Post a Comment