নিলিমা মন খারাপ করে বাসায় ফিরে গেলো। আসলে ছোটো ভাইয়ের খেলা দেখতে তার ভালোই লাগে। কিন্তু তার ছোটো ভাই শুভ তাকে দেখলেই এমন বিহ্যাভ করে।
নিলিমা ঘরে এসে কান্না করতে থাকে। তার মনে পড়ে যায় ১০ বছর আগের কথা। যখন শুভ মাত্র চার বছর বয়সের। একদিন খেলতে খেলতে শুভ'র বাম চোখে একটা কঞ্চির মাথা ঢুকে যায় আর তার চোখটি অন্ধ হয়ে যায়। সবাই সেদিন শুভকে নিয়ে হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন চোখ ট্রান্সপ্লান্ট করা পসিবল। কিন্তু কে শুভ কে চোখ দিবে। সবাই শুভ'র কেবিনে শুভকে ঘিরে কান্না করছে। এমন সময় নিলিমা বললো মা, আমি চোখ দিবো। আমার ভাইকে আমি জীবনের চেয়েও ভালোবাসি। আমার এক চোখ দিয়ে হলেও আমার ভাইকে আমি সুন্দর দেখতে চাই। নিলিমা কোনো বুঝ ই শুনলোনা। শেষ পর্যন্ত নিলিমার এক চোখের বিনিময়ে শুভ ফিরে পেলো দুই চোখ ভরে পৃথিবী দেখার অধিকার।
নিলিমার অনুরোধ রাখতে গিয়ে কেউই শুভ কে বলে নাই যে তার ছোটো বয়সে ওমন কিছু হয়েছিলো। তাই শুভ ভুলে গিয়েছে সব সময়ের সাথে সাথে।
সেদিন শুভ বাসায় ফিরে এসে রাতে খাওয়ার টেবিলে মা'কে বলে, "মা তোমার মেয়ে যেনো যখন তখন আমার বন্ধুদের সামনে না যায়। আর খেলার মাঠে যখন আমি খেলি ও যেনো না যায়।"
মা বললেন কেনো?
শুভ বললো ও গেলে সবাই কেমন চোখে তাকায়। আর আমার লজ্জা লাগে। আর বলোতো মা ওর এক চোখ নেই এটা দেখলে তো আমারই বিশ্রি লাগে। ও সবার সামনে ওভাবে না যেয়ে ঘরে বসে থাকলেই তো পারে।
নিলিমার চোখে পানি আটকালোনা, তবুও বললো। আচ্ছা ভাই। যাবোনা। তুই খেলিস। আমার চোখ নাই, দেখতে বিশ্রি লাগে আমি জানি। তাই আসলে আমার যাওয়াটাই ভুল হয়েছিলো। চুপ করে খেয়ে নে ভাই।
শুভ এরপরেও বলে, "শুন আপু আমার রুমেও রাত বিরাত আসবিনা। আর আসলেও বলে ঢুকবি। কারন হঠাৎ তোকে দেখলে আমার কেমন যেনো লাগে।"
নিলিমার চোখের পানি আরো বাড়লো, বললো ঠিক আছে ভাই। তোর ইচ্ছা মতই সব হবে।
এতক্ষণ সব কথা শুনলেন তাদের মা বাবা। কিছুই বললেন না। খাওয়া শেষ করে, শুভকে ডাকলেন মা বাবা। তার পরে প্রথমে নিলিমার একটা ছবি দেখালেন। শুভ বললো হায় আল্লাহ, এটা নিলিমা। তাইলে তার আরেক চোখ কই গেলো এখন। তখন তো দেখছি দুটা চোখ ই আছে। এখন কেনো নেই।
উত্তরে মা কিছু বললেন না।। তিনি আরেকটা ছবি দেখালেন তাতে দেখা যাচ্ছে, শুভ'র ছোট্ট বেলার একটা ছবি তাতে মা বাবা নিলিমা সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হসপিটালের একটা বেডের পাশে। যেখানে শুধুমাত্র শুভ'র এক চোখ নেই। কিন্তু মা, বাবা, নিলিমা সবার চোখ ঠিক আছে।
শুভ শিউরে উঠলো। বললো কিভাবে আমার এ অবস্থা হয়েছিলো।
এবার মা কথা বললেন। কঞ্চির খোচায় এরকম হয়েছিলো।
মা আরো একটি ছবি বের করলেন তাতে দেখা যাচ্ছে আগের মতোই সবাই শুভ'র বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুভর কানা চোখে একটি নতুন চোখ লাগানো হয়েছে। কিন্তু এবারের ছবিতে নিলিমার এক চোখ নেই।
শুভ ঘামতে লাগলো। সে মা কে বললো মা, আমার চোখ কিভাবে ফিরলো। আর নিলিমা আপুর চোখ কই গেলো।
মা আর জবাব দিলেন না। মায়ের দু গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। শুভ তাকিয়ে দেখে বাবা ও কান্না করছেন।
শুভ সব বুঝে গেলো এক নিমিষে। এক দৌড়ে সে নিলিমার ঘরে চলে গেলো। নিলিমা ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। শুভ যেয়েই নিলিমাকে জড়িয়ে ধরলো, আর কান্না করতে লাগলো। শুভ'র ধাক্কায় নিলিমার ঘুম ভেঙে গেলো। সে উঠে বসে শুভকে বুকে টেনে নিলো আর বললো কি হইছ ভাই। এভাবে কান্না করছিস কেনো। কিছু দেখ ভয় পাইলি না-কি।
শুভ বলল, না আপু। শুধু একটা জবাব দাও। কেনো তুমি আমাকে সুন্দর করতে গিয়ে নিজে অসুন্দর হয়ে গেলে। নিলিমার দুচোখে জল চলে এলো। সে কিছুই বলতে পারলোনা। সে শুভ'র চোখের পানি মুছে দিলো নিজের ওড়না দিয়ে, আর শুধু বললো তুই যে আমার কলিজার টুকরা ভাই৷
পরদিন থেকে দেখা গেলো। নিলিমার হাত ধরে শুভ খেলার মাঠের এক কোনে বসে আছে। আর দুজনে মিলে সকলের খেলা দেখছে। নিলিমা অনেক বুঝিয়েও শুভকে খেলতে পাঠাতে পারলোনা। কারন সে আজকে আর খেলার মাঝে নয় বরং তার আপুর হাসিতেই আনন্দ খুঁজে পেয়েছে।
পৃথিবীর সকল বোনদের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
No comments:
Post a Comment